দ্বীনের মাঝি তিনি বাংলার মাওলানা তারেক জামিল হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে আল্লাহ তালা হযরতের দ্বারা অনেক কাজ নিচ্ছেন। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন হযরতের হায়াত দারাজ করেন। আমিন।
Thursday, 6 September 2012
Tuesday, 4 September 2012
দুনিয়া নয় আখেরাতই প্রকৃত গন্তব্য
মাওলানা যোবায়ের হাসান, নিজামুদ্দীন, দিল্লী
[ ২১ জানুয়ারি ২০১১, শুক্রবার, বাদ আসর]
মেরে আযীয, দোস্ত ও বুযুর্গ! মানুষ এই দুনিয়াতে অতি অল্প সময়ের জন্য এসেছে। এটা থাকার জায়গা নয়। ইবাদতের স্থান। একদম ক্ষণস্থায়ী। যারা একবার এসেছে, তারা অবশ্যই চলে যাবে। যারা চলে গেছে তারা আর কখনও ফিরে আসবে না।
মেরে দোস্ত! দুনিয়া অতি অল্প সময়ের স্থান। এখানে কেউ চিরদিনের জন্য আসেনি। কেউ থাকতেও পারবে না। আমাদের চিরস্থায়ী বাসস্থান তো মৃত্যুর পর। সেখানের প্রস্তুতির স্থান এটা। এখানে যারা নিজের ঈমান-আমল সঠিকভাবে তৈরি করে নেবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন। তাদের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় চাওয়া-পাওয়া।
মেরে দোস্ত, আল্লাহর নিকট দুনিয়ার মূল্য একটা মাছির ডানার সমানও নয়। যদি এর কোনো মূল্য থাকতো তাহলে কাফেরদেরকে একটা দানাও দেয়া হতো না। আল্লাহর কাছে মূল্য একমাত্র খাঁটি ঈমানের। খালেস আমলই আল্লাহর নিকট দামী। মানুষের নিকট থেকে এই ঈমান-আমলই উদ্দেশ্য।
পেয়ারে দোস্ত, মানুষের ঈমান-আমল খালেস হলে তাদের নিকট সম্পদের কোনো মূল্য থাকে না। সম্পদ না থাকার কারণে তারা আফসোস করে না। দারিদ্রের কারণে দুনিয়াতে যে কষ্ট হবে কিয়ামতে এর বদলা তাদেরকে অবশ্যই দেয়া হবে। যারা দুনিয়া ভুলে আখেরাতের কাজ করবে যে কোনোভাবে তাদের এ জীবন কেটেই যাবে। কিন্তু যারা আখেরাত ভুলে দুনিয়া গ্রহণ করবে, দুনিয়ার ডুবে যাবে কিয়ামতের দিন তাদের আফসোসের শেষ থাকবে না। কারণ সেই জীবনের তো শেষ নেই। চিরদিনের স্থায়ী বাসস্থানের জন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু?
পিয়ারে দোস্ত ও বুযুর্গ! আমরা দুনিয়ার কাজকেই আপন সুখ শান্তির মাধ্যম ভাবছি। অথচ সুখ-শান্তি দুনিয়ার কাজ-কর্ম, ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্রের ওপর নির্ভরশীল নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপরই সবকিছু নির্ভর করে। ঈমান-আমল ঠিক করে যে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারবে, আখেরাতে সেই কামিয়াব হবে। পার্থিব এই দুনিয়া তো থাকার জায়গা নয়। এখান থেকে একদিন যেতেই হবে। মানুষ যত সম্পদই অর্জন করুক সেগুলোর কিছুই তার সঙ্গে যাবে না। যাবে শুধু তার আমল। আমাদেরকে সেদিকেই খেয়াল রাখতে হবে।
মেরে আযীয, দোস্ত! আল্লাহ আমাদের মঙ্গলের জন্য দাওয়াতে তাবলিগের মেহনতের সুযোগ করে দিয়েছেন। আমাদের এটার কদর করা চাই। এর মাধ্যমে নিজ ঈমানকে মজবুত করার, আমলকে ঠিক করার মন-মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। যেহেতু আমাদের মূল্য উদ্দেশ্য নয় আসল টার্গেটই আখেরাত সেখানের কামিয়াবির জন্য দ্বীনি দাওয়াতের সঙ্গে জুড়তে হবে। দাওয়াত ও তাবলিগকে আমাদের জীবনের লক্ষ্য বানাতে হবে। মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে। তাদেরকে আল্লাহর পথের দিকে ডাকতে হবে। এসবের মাধ্যমেই আমরা আল্লাহর নিকট প্রিয় হয়ে উঠবো। আমাদেরকে আল্লাহর নিকট ক্ষমাও চাইতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের কাজ, দাওয়াতের কাজেই জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। আমাদের এতে দুর্বলতা রয়েছে। অবহেলা হয়েছে। দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি। তার কাছে মাফ চাইলে তিনি খুশি হবেন এবং তিনি আমাদের মাফ করে দেবেন।
মেরে আযীযো, মানুষ দ্বীনের কাজকে নিজের কাজ বানিয়ে নিলে আল্লাহ তার পেরেশানি দূর করে দেন। পক্ষান্তরে দুনিয়ার কাজকে আপন কাজ বানালে আল্লাহ তার পেরেশানি বাড়িয়ে দেন। এ জন্য আমাদেরকে দ্বীনের মেহনতের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে। মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে। তবেই আমাদের জিন্দেগী শান্তির হয়ে উঠবে। সব পেরেশানি দূর হয়ে যাবে। আমরা যারা এখানে এসেছি- সবাই আল্লাহর নিকট তাওবা করি। আল্লাহর উদ্দেশ্য অনুযায়ী দ্বীনের কাজের ওপর বেশি বেশি মেহনত করি। যেন আমরা সবাই আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হয়ে যাই। প্রত্যেক মানুষের ওপর দু’টি বড় দায়িত্ব রয়েছে। এক. আল্লাহর বান্দা হিসেবে খালেস ঈমানে তাঁর ইবাদত করা। দুই. নবীর উম্মত হিসেবে সবার ওপর দায়িত্ব হলো, অন্য ভাইয়ের কাছে যাওয়া এবং তাদেরকে আল্লাহর দাওয়াত দেয়া।
মেরে ভাইয়ো! আমরা তো দুর্বল, আল্লাহ মহান। তাঁর কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা মেহনত করে তাঁর কাছে দোয়া করবো। আল্লাহ ইচ্ছে করলে তিনি সবাইকে হিদায়াত দিতে পারেন। সবার হিদায়াতের জন্যই আমরা দোয়া করি। বান্দার কাজই তো মেহনত ও দোয়া করা। আর আল্লাহর কাজ বান্দার দোয়া কবুল করা। আমরা দোয়া করি আল্লাহ সবাইকে কবুল করুন। আমীন।
অনুলিখন : আবুল কালাম আনছারী
আল্লাহর পথে অগ্রগামীরা জান্নাতেও অগ্রগামী
মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ, দিল্লী
[হেদায়েতী বয়ান, ২৩ জানুয়ারি ২০১১, রোববার]
মেরে ভাই ও দোস্ত! আমাদেরকে দাওয়াত দিতে হবে- আসবাবের মোকাবিলায় ঈমানের। কারণ সবার মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, আমি চাকরি করবো। তাই আল্লাহ খাওয়াবেন। আমি ব্যবসা করবো, আল্লাহ খাওয়াবেন। বরং আল্লাহর ওয়াদা রয়েছে এ কথার ওপর যে, বান্দা তার ঈমান ঠিক করে আল্লাহর ইবাদত করবে তো আল্লাহ তাকে খাওয়াবেন। ইবাদতের সঙ্গেই আল্লাহর ওয়াদা রয়েছে। আসবাবের সঙ্গে তার ওয়াদা নেই। আমরা নামাযের দাওয়াত দেবো। কারণ কালেমার পর মুসলিমের ওপর সর্বপ্রথম ফরজ হলো নামায। কারো নামায ঠিক হয়ে গেলে সবই ঠিক হবে। অর্থাৎ ইবাদত ঠিক হলেই আমাদের রিযিকের ফায়সালা হবে। অন্য সবই আসবে আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে। একবার রাসূলের প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা রা. খুব কষ্টে ছিলেন। অভাবের কারণে তাদের খাওয়ার কোনো বস্তু ছিল না। তিনি রাসূল সা. এর নিকটে গেলেন। বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা খুব ক্ষুধার্ত। তাসবিহ তো ফেরেশতাদের খোরাক। তারা তাসবিহ পড়লেই তাদের খাবার চাহিদা শেষ হয়ে যায়। আর আমাদের খাদ্য চাহিদা আসবাবের ওপর নির্ভর করে। আমাকে খাবারের কিছু দিয়ে দিন। রাসূল সা. তার কথা শুনলেন। তারপর বললেন, ফাতেমা! তোমার খাবার জন্য যদি পেরেশানী থাকে, তবে আমার নিকট অনেকগুলো দুম্বা আছে। তোমাকে সেগুলো দিয়ে দিতে পারি। তবে কতক্ষণ পূর্বে জিব্রাইল আ. এসে আমাকে পাঁচটি কালেমা শিক্ষা দিয়ে গেছে। তুমি চাইলে সেগুলো নিয়ে যেতে পারো। ফাতেমা রা. কোনো কথা না বলে কালেমা নিয়ে ফিরলেন। হযরত আলী রা.কে বললেন, আমি দুনিয়া প্রার্থনার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আখেরাত নিয়ে ফিরে এসেছি। এখানে তিনি আমাদেরকে আমল শিখিয়েছেন। তিনি আসবাবের পেছনে না পড়ে আমল নিয়ে ফিরেছেন। আমরা ব্যবসা করি, সরকারি চাকরি করি। নামাযের সময় হয়ে যায়, তবু দোকানে-অফিসে বসে থাকি। কারণ আমাদের অন্তরে এ কথা বসে আছে যে, রিযিক আসবাবের দ্বারাই আসে। এজন্য আমাদের সর্বপ্রথম এ কথার দাওয়াত দিতে হবে যে, রিযিক আল্লাহ দেন। সর্বপ্রথম নামাযের জন্যই দাওয়াত দিতে হবে।হাদীস শরীফে এসেছে, মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য নামায, এমনটা কল্পনা করা যায় না যে, কোন কাফের নামায পড়বে। আর কোনো মুসলিম নামায পড়বে না। নামায ছেড়ে দেবে। ইসলামে নামাযই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। আমরা যদি এই নামায ঠিক করে নেই, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা এখন আল্লাহর রাস্তায় আছি। এখানে আমাদের নামাযের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ধীরে-স্থিরভাবে রুকু করবো। রুকু থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবো। দীর্ঘ কেরাত দ্বারা নামায পড়বো। নামাযে দাঁড়িয়ে এমন মনে করবো যে, আল্লাহ আমাকে দেখছেন। আমার কেরাত, তাসবিহ শুনছেন। আমিও আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছি। যদি এভাবে ইবাদত করি, তাহলে আমার উবাদত অবশ্যই কবুল হবে। এই অবস্থা একদিনে আসবে না। বারবার প্রতিদিন প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অবিরাম চেষ্টা করে যেতে হবে। তবেই আমাদের নামায ঠিক হবে। আমাদের ইবাদত ঠিক হয়ে যাবে। আর এভাবে নামায আদায় করে আল্লাহর নিকট দুআ করলে, আল্লাহ তার সব প্রয়োজন পূরণ হবে। আমরা নামাযের মাধ্যমেই আল্লাহর কাছ থেকে সবকিছু পেতে পারি। রাসূল সা. এর জামানায় একবার অনাবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কোথাও পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। চারিদিকে শুধুই হাহাকার। জুমার দিন। রাসূল সা. মিম্বরে দাঁড়িয়েছেন খুতবা দেয়ার জন্য। মসজিদের মধ্যের দরজায় দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কাছে বৃষ্টির দুআ করুন। কোথাও তো পানির ব্যবস্থা নেই। লোকজন হাহাকারে পড়ে গেছে। রাসূল সা. সেখানে থেকেই হাত উঠালেন। আল্লাহর কাছে পানির জন্য বৃষ্টির দুআ করলেন। তিনি হাত নামানোর পূর্বেই দেখা গেল, বৃষ্টির পানিতে তার দাড়ি মোবারক ভিজে গেছে। এভাবে এ সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টি হতে থাকলো। খাল-বিল, নদী-নালা সব ভরে গেল। পরের জুমার দিন সেই সাহাবী আবারো রাসূল সা. এর কাছে দুআ চাইলেন। রাসূল সা. আল্লাহর দরবারে দুআ করলেন। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে রোদ উঠলো। রাসূল সা. এখানে আমাদেরকে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ থেকে নেয়া শেখালেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা সাহায্য চাও আল্লাহর নিকট সবর ও নামাযের মাধ্যমে। অতএব, আমরা যদি আল্লাহর কাছে দুআ করি, তাহলে অবশ্যই আমাদের দুআ কবুল হবে। সব প্রয়োজন পূরণ হবে। তবে আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে- ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য আমাদের খাদ্য, আমাদের কামাইও হালাল হতে হবে। নইলে কোন ইবাদত কবুল হবে না। কোনো দুআও কবুল হবে না। সমস্যা নিরসনের জন্য দুআ করলে, আল্লাহ তার জবাবে বলবেন, তোমার দুআ কিভাবে কবুল করি? তোমার খাবারে হারাম, পোশাকে হারাম। সবাই হারামে ভরপুর। তার দুআ কবুল হবে না। সুতরাং আমাদের কামাই, আমাদের ইনকাম হালাল হতে হবে। ভাই ও দোস্ত! আমাদের দায়িত্ব অনেক। সবগুলোই আঞ্জাম দিতে হবে। আমাদের সব কিছু ঠিক করার জন্য ইবাদত প্রথম শর্ত। আর ইবাদত মসজিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সে জন্য মসজিদের দিকে অগ্রসর হতে হবে। মসজিদের দিকেই দাওয়াত দিতে হবে। মসজিদে নিয়মিত তালীমের ব্যবস্থা করতে হবে। লোকজনকে সেখানের দাওয়াত দিতে হবে। তারা যখন সময় দিতে রাজি হয়, তখনই তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তালীম করতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা তালীমের ব্যাপারে অনেক ওয়াদা করেছেন। অনেক দাওয়াতের ঘোষণা দিয়েছেন। সেগুলো জানার জন্য সওয়াব পাবো যে, সেটার বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য তালীমের মজলিসে বসবো। দীনের কথা-ঈমানের কথা বারবার পড়বো, শুনবো। পরিপূর্ণ মনোযোগসহ শুনবে। তবেই তাতে বিশ্বাস আসবে। আর তালীম চলার সময় অন্যদেরও ডাকতে হবে। যেন মসজিদের পবিত্র পরিবেশে এসে অন্যরাও উপকৃত হতে পারে। সবাই উত্তম কাজে শরীক হতে পারে। এজন্য মসজিদে আসার ফযীলত-উপকারিতা বয়ান করতে হবে। মসজিদে এলে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন, তাকে দীনের জন্য কবুল করে নেবেন। তাকে শান্তি দেবেন। তাকে জান্নাত দান করবেন। সর্বোপরি তার জন্য রহমতের ফায়সালা করবেন। মসজিদে এলে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাকে এভাবে অনেক পুরস্কার দেবেন। এখন ফযীলত বলে সবাইকে তালীমের মজলিসে বসানোর চেষ্টা করবে। তবে একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, আমাদের কাজ বান্দার কাজ বন্ধ করা নয়। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট, কল-কারখানা বন্ধ করে দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদেরকে বুঝিয়ে মসজিদে নিয়ে এসে মসজিদেই তাকে বুঝাতে হবে। বাইরে তাকে বুঝাতে গিয়ে সময় নষ্ট করবো না। এভাবে মসজিদে বারবার তালীমের মজলিসে বসে আমাদের ঈমান মজবুত করতে হবে। আল্লাহর কাছ থেকে সবকিছু নেয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এভাবে বেশি বেশি তালীমের দ্বারা ফযীলতগুলো আমার মুখস্থ হয়ে যাবে। সে অনুযায়ী আমল করাও সহজ হয়ে যাবে। মেরে ভাই ও দোস্ত বুযুর্গ! প্রত্যেক আমল কবুল হওয়ার জন্য যেমন ইখলাস জরুরি, তেমনিভাবে আমলটা রাসূল সা. এর তরীকা অনুযায়ী হওয়াও অপরিহার্য। আর রাসূল সা. এর তরীকা জানার জন্য ইলম জরুরি। সে জন্য আমাদের বেশি বেশি তালীম শুনতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো- আমাদের সন্তানদেরকে কুরআনী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। প্রতিটি মহল্লার প্রতিটি মসজিদে কুরআনী মক্তব কায়েম করতে হবে। যদি আগে থেকেই মক্তব থাকে, তাহলে সেটাকে আরো জোরদার করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, এটাও আমাদের গাশতেরই একটি অংশ। ছেলেদের যদি সকাল বেলা স্কুল থাকে, তবে বিকেলে তাদের মসজিদে পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মাদরাসায় পড়ানোর ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। তবেই আমাদের কওম, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম ইসলামের ওপর থাকবে। আমাদের সামনে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো যিকির। আরো মনোযোগ দিয়ে, দিল ও মন লাগিয়ে আল্লাহর যিকির করবো। যিকিরহীন দেল মরা। তাতে কিছুই থাকে না, সেজন্য আমাদের যিকির করতে হবে। আর যিকির করতে হবে দেল দিয়ে, মন লাগিয়ে। কেননা যিকিরে মনোযোগ না থাকলে অলসতা আসে। আর এতে বিদআতের সৃষ্টি হয়। সেজন্য আমরা বেশি বেশি যিকির করবো এবং দেল লাগিয়ে করবো। তাহলে আমাদের অন্তর জীবন্ত হবে, ঠোঁট তরতাজা হবে। কিয়ামতের মুক্তি এর উপরই নির্ভর করছে। উল্লিখিত কালেমা, নামায, ইলম ও যিকির, এসব তখনই কাজে লাগবে, যখন আমরা সেগুলো সাহাবা কেরামের তরিকা অনুযায়ী করবো। যদি তাদের তরিকা অনুযায়ী করি তবেই আল্লাহর ওয়াদা ফযীলত পাওয়া যাবে। সাহাবায়ে কেরাম হেঁটে হেঁটে দীনের দাওয়াত দিয়েছেন। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন। আমরা যদি আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে মানুষদের দীনের দাওয়াত দিই। তাহলেই কেবল যেসব সওয়াব পেতে পারি। আমরা যতো দ্রুত দীনের পথে, আল্লাহর রাস্তায় বের হবো, ততোই বেশি সওয়াব পাবো। রাসূল সা. এর সময়। তিনি একবার একটি জামাত তৈরি করে আল্লাহর রাস্তায় পাঠিয়ে দিলেন। তারা চলে গেল। রাসূল সা. তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখনো যাওনি কেন? সাহাবী উত্তর দিলেন, আমরা সঙ্গে জামাতে নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে দেরি করছি। রাসূল সা. তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যারা তোমার আগে চলে গেছে, তারা জান্নাতে তোমার চেয়ে কমপক্ষে পাঁচশো বছরের রাস্তা এগিয়ে গেছে। এখান থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, আমরাও যখন আল্লাহর রাস্তায় বের হবো। তখন যতো দ্রুত সম্ভব বের হবো। জামাতের রুখ দিয়ে দেয়া হলে- এলাকা নির্ধারণ করে দেয়া হলে আমরা দ্রুত বেরিয়ে পড়বো। এতেই আমাদের কামিয়াবী। আরেকটি কথা হলো, আল্লাহর রাস্তায় যতদূর সম্ভব পায়ে হেঁটে চলবো। এতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে। আবার অধিক লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার কারণে তাদেরকে দাওয়াত দেয়ারও সুযোগ হবে। এ কথার অর্থ এই নয় যে, প্রয়োজন হলেও আমরা যানবাহন ব্যবহার করবো না। দূরবর্তী স্থানে যেতে হলে তো অবশ্যই যানবাহনে যেতে হবে। তবে সেখানেও যাদেরকে পাবো, তাদেরকে দীনের দাওয়াত দেবো, হিকমতের সঙ্গে সবার কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছানোর চেষ্টা করবো। আমরা যেই এলাকাতেই যাবো, যাওয়ার সময় মাসনূন দুআগুলো পড়ে যাবো, সেখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দু’রাকাত নামায আদায় করে এলাকাবাসীসহ সারা বিশ্বের সবার জন্য, সবার হেদায়েতের জন্য দুআ করে নিবো। তার আগে আমাদের নিয়তকে খালেস করে নেই। এমন যেন না হয় যে, এখানে এসেছি আমার কোন আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাতের জন্য বা অন্য কোনো স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। তাহলে আমাদের সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে যাবে। মূল উদ্দেশ্যই পূরণ হবে না। নামায শেষে আমাদের প্রথম কাজ হবে, মাশওয়ারা-পরামর্শ করা। এটাকে কোনো সাংগঠনিক কাজ মনে করবো না। বরং এটাকে একটা ইবাদত মনে করবো। সবাই যার যার মতামত পেশ করবে। অতি নগণ্য কারো মতামত নেয়ার ক্ষেত্রেও সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকবে। কারো মতের বিরোধিতা না করা। আবার নিজের মতামত উল্লেখ করার পরও তার ওপর আলোচনা করা থেকে বিরত থাকা। আমীর সাহেব যেটার ফায়সালা করেন, সেটাকেই নিজের অভিমত বলে মনে করা। মাশওয়ারায় সর্বপ্রথম নিজেদের খাবার ব্যবস্থাপনা করা, যেন কেউ এমনটা ভাবতে না পারে যে, আমরা অন্যদের কাছে কিছু পাওয়ার আকাক্সক্ষী। অন্যদের নিকট থেকে চাই। অন্যদের মুখাপেক্ষি। অন্যদের দাওয়াতের সুযোগ না দিয়ে আমরা নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরাই করবো। এতে এলাকার মধ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আল্লাহর রহমতও বর্ষিত হবে। মাশওয়ারায় অন্য সব কাজেরও তারতীব ঠিক করে নেয়া। এলাকায় দাওয়াতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বের প্রতিও কিছুটা লক্ষ্য রাখা, যাকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, তার কোনো দোষ-ত্র“টি না ধরা। কারণ দোষ ধরলে সে কোনো কথাই শুনবে না। এজন্য তার ভালো দিকগুলো উল্লেখ করে তার দ্বারা কাজ নেয়ার চেষ্টা করা। আমরা যেই মহল্লায় যাবে, যেই মসজিদে যাবো, সেখানের সবগুলো মসজিদে পাঁচ কাজ চালু করা ও প্রতিটি ঘরে তালীম চালু করা এবং ছয় নম্বরের মুজাকারা চালু করা। যেন ঘরের মহিলারাও দীনের দা‘য়ী হয়ে যায়। সবার ঘরে ঘরে দাওয়াত ও তাশকিলের কাজ জমিয়ে তোলা। এমনটা যেন না হয় যে, আমরা শুধু মসজিদ অতিক্রম করে চলে গেলাম। মনে রাখতে হবে, আমাদের কাজ চিল্লা পূরণ করা নয়। আল্লাহর দেয়া জান-মাল তার পথে বেরিয়ে সঠিক ব্যবহার শেখা এবং নিজ কর্তব্য পালনই আমাদের দায়িত্ব। আমরা যদি তার পরিপূর্ণ হক আদায় করতে ব্যর্থ হই, তবে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অতএব, আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকেই চেষ্টা করি ও আল্লাহর কাছে দুআ করি। আল্লাহ সবাইকে দীনের জন্য কবুল করেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মানুষের হেদায়েতের ফায়সালা করুন। আমীন।
অনুলিখন :: আবুল কালাম আনছারী
দ্বীন কায়েমের জন্য ইবরাহিমী মেজাজ তৈরি করতে হবে
মাওলানা শওকতুল্লাহ, দিল্লী
[২১ জানুয়ারি ২০১১, বৃহস্পতিবার, বাদ মাগরিব]
মেরে ভাই দোস্ত ও বুযুর্গ! আল্লাহতাআলা এই উম্মতকে এ জন্য দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন যে, তারা দুনিয়াতে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবে। এজন্য যত জান-মালের প্রয়োজন হয় তারা তা ব্যয় করতে কার্পণ্য করবে না। এ উম্মত ইবরাহিম আ. এর দোয়ার ফসল। ইবরাহিম আ. দোয়া করেছিলেন, “হে আল্লাহ! তুমি দুনিয়াতে এমন একটি উম্মত তৈরি কর, যারা তোমার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করবে। সারা পৃথিবীতে দ্বীন ছড়িয়ে দেবে। এমন একটি শক্ত উম্মত তুমি দুনিয়াতে পাঠাও।”
ইবরাহিম আ. আরো দোয়া করেছিলেন, “আমি তোমার হুকুম পেয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আমার সন্তানকে মরুভূমিতে খাদ্য-পানি ছাড়া রেখে এসেছি। ইসমাইলকে তোমার হুকুমে কুরবানী করেছি। এ ব্যাপারে আমি তোমার হুকুমের বিন্দুমাত্র পিছপা হইনি। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, দুনিয়াতে এমন এক উম্মত পাঠাও যারা দ্বীনের জন্য আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার হুকুম এলে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। জীবন কুরবানী দেয়ার হুকুম এলে জীবন কুরবানী করবে। তোমার হুকুমের কোনোরূপ ব্যতিক্রম করবে না। যারা দুনিয়াতে তোমার নাম উঁচু করার জন্য মুজাহাদা চালিয়ে যাবে।” এটি ছিল ইবরাহিম আ. এর প্রথম দোয়া। তার দ্বিতীয় দোয়া ছিল, হে আল্লাহ! তুমি দুনিয়াতে এমন একজন নবী প্রেরণ করÑ যিনি আমার স্বপ্নকে দুনিয়াতে বাস্তবায়ন করবে। তোমার জাতকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ইবরাহিম আ. এর দোয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ সা. কে এমন করে পাঠিয়েছেন। আর এই নবীর উম্মতই হলাম আমরা, যার জন্য ইবরাহিম আ. দোয়া করেছিলেন। নবী মুহাম্মদ সা. দুনিয়াতে এসে ইবরাহিম আ. -এর রেখে যাওয়া স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা শুরু করলেন। উম্মতকে ডেকে বললেনÑ আমার পরে কোনো নবী আসবে না। তোমরা দ্বীনের কাজ করবে আমার দাদা ইবরাহিম আ. -এর মেজাজে। নবী করিম সা.ও উম্মতের মাঝে চেষ্টা-মুজাহাদা চালিয়েছেন ইবরাহিমী মেজাজে। রাসুল সা. এর মেহনতে সাহাবারা এমন ঈমান তৈরি করেছেন যে, তাদেরকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলা হলে তারা তাই করত।
নবী করিম সা. এর মক্কার ১৩ বছরের দাওয়াত ছিল মেজাজ তৈরির দাওয়াত। এ মেহনত এমনই ছিল যে, মানুষের পাথর দিল ফুলের মতো নরম হয়ে গেছে। ৩৬০ মূর্তির পূজা করা দিল দ্বীনের মেহনতে পরিণত হয়েছে। এ মেহনত তখনকার ছিল যখন মানুষ কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত। গোলামকে অমানষিক নির্যাতন চালাত। দয়া কী জিনিস তারা জানত না। আবু জাহেল বলত তোমাদের কোনো মেয়েকে যদি জীবন্ত কবর দিতে ভয় হয় তবে ওমরকে দায়িত্ব দিও। তার দিল কখনও ভীত হয় না। এই ছিল ওমর। কিন্তু রাসুল সা. এর দাওয়াতের ফলে তার ঈমান এতই শক্ত হয়ে গেল যার কোনো তুলনাই হয় না।
ওমর রা. এর শাসনাকালে একবার বাগদাদে বিশাল বন্যা হল। ওমর রা. নিরাপত্তা বাহিনীকে হুকুম দিলেন কোনো অবস্থাতেই যেন একজন মানুষেরও ক্ষতি না হয়। একদিন বাগদাদ থেকে একটি চিঠি এল। লেখা হয়েছেÑ আল্লাহর রহমতে বন্যায় একজন মানুষেরও ক্ষতি হয়নি। তবে একটি কুকুর মরে পানিতে ভেসে গেছে। ওমর এটি পড়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আর বলতে লাগলেনÑ আমাকে যখন আল্লাহ জিজ্ঞেস করবে হে ওমর! তোমার শাসনামলে একটি কুকুর পানিতে পড়ে মারা গেল কেন? এর জবাব দাও? তখন আমি কি জবাব দেব? দোস্ত! বুঝে দেখুনÑ যার দিল ছিল এত নিষ্ঠুর, সে দাওয়াতের মেহনতে এত বুঝমান হয়ে গেল। নিজের ১০ মেয়েকে জ্যান্ত কবর দেয়ার পরও যার একটু দয়া হল না, একটি কুকুর মরাতে তার এত ভয় হচ্ছে! এই হল ইবরাহিমী দাওয়াতের মেজাজ। একবার ওমর রা. কাবাঘর জিয়ারত করছিলেন। হাজরে আসওয়াদ চুমো দেয়ার সময় বললেন, হে পাথর! তোমাকে আমি কখনোই চুমো দিতাম না। আমি জানি তোমার কোনো শক্তি নেই। কিন্তু আমি আমার হাবিবকে চুমো দিতে দেখেছি তাই তোমাকে চুমো দিচ্ছি। রাসূলের প্রতি আমাদের মহব্বতও এমন হতে হবে। পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হবে। দুনিয়াতে যা কিছু আছে, ছোট বড় সব আল্লাহর সৃষ্টি। এসব ব্যক্তিগত কোনো অর্জন নয়। যতক্ষণ আল্লাহ এসব রাখবেন ততক্ষণ এসব থাকবে। যখন ধ্বংস করবেন তখন ধ্বংস হয়ে যাবে।
ইবরাহিম আ. কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করতে দেখে জিবরাইল আ. সাহায্য করতে আসলেন। তাকে দেখে ইবরাহিম আ. বললেন, তোমার সাহায্য আমার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি আমার রব আমাকে আগুনে জ্বালাতে চান, আমি আগুনে জ্বলতে প্রস্তুত। আর যদি আমাকে সাহায্য করতে চান, তার সাহায্যই আমার জন্য যথেষ্ট। ইবরাহিমী মেজাজ ছিল এমনই। সবকিছু ভুলে গিয়ে আল্লাহর জাতের ওপর আস্থা স্থাপন করা অপরিহার্য।
ঈমান যখন পরিপূর্ণতা পাবে আল্লাহ তাআলা গায়েবীভাবেই তাকে সব অনিষ্ট থেকে হেফাজত করবেন। ইবরাহিম আ. এর ঈমান পূর্ণ ছিল তাই আগুন থেকে তাকে রক্ষা করেছেন। আগুন তার জ্বালানো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ইবরাহিম আ. আগুনে অবস্থানের দিনগুলোর স্মৃতি বর্ণনা করছিলেনÑ আমি যতদিন আগুনে ছিলাম ততদিন এমন শান্তিতে ছিলাম যেমন শান্তি আর কখনোই পাইনি। আমাদের ঈমানকেও তাই এমন পরিপূর্ণ করতে হবে। পাকাপোক্ত করতে হবে।
ভাই, দোস্ত ও বুযুর্গ! আল্লাহ তাআলার শক্তি সবখানে সমানভাবে চলে, চাই মাখলুক ছোট হোক অথবা বড়, পাহাড়-জঙ্গলে হোক আর অন্য যে কোনো স্থানেই হোক না কেন। আল্লাহ সবার রিযিক সমানভাবে পৌঁছাতে পারেন। প্রত্যেকের খোঁজ-খবর নেয়া তার জন্য এতটুকু কষ্টও হয় না। বলা হয়েছে, অন্ধকার রাতে কালো পাহাড়ের পাদদেশে একটি ছোট্ট কালো পিপড়ার নরম পায়ের আওয়াজও আল্লাহ শোনেন। এসব প্রতিবন্ধক আমাদের জন্য, খালেকের জন্য নয়। ভাইয়েরা! দুটি বস্তু এমন রয়েছে, যার থেকে কেউ দূরে থাকতে পারে না। ১. মানুষ যদি লোহার খাঁচার মধ্যেও প্রবেশ করে। সেখানে কোনো বাতাস পৌঁছে না, আলো পৌঁছে না। কিন্তু মৃত্যুর সময় এলে সেখানেও আজরাইলের হাত থেকে বাঁচতে পারবেনা। ২. রিযিকের সময় হলে বান্দা যেখানেই থাক, তার নিকট রিযিক পৌঁছবেই। কেউ বাঁধা দিতে পারবে না।
মুহতারাম দোস্ত! আরেকটি কথা হলো, আল্লাহ তাআলা বান্দার রিযিকের জন্য খাদ্য-শস্যের মুহতাজ নন। খাদ্য ছাড়াও তাদের রিযিক দিতে পারেন। যেমন কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে যখন ঈমান নিয়ে থাকা কঠিন হবে। মানুষ তখন পাহাড়ে আশ্রয় নেবে। ক্ষিধে পেলে তারা তাসবিহ পড়বে। আল্লাহ তাদের ক্ষিধে মিটিয়ে দেবেন। এটাও রিযিক। সমস্ত মাখলুকের রিযিকদাতা আল্লাহ। কার কী রিযিক সেটাও তিনিই জানেন। প্রত্যেকের রিযিক ঠিকমতো পৌঁছেও দিচ্ছেন।
ভাইয়েরা! মাখলুকের মধ্যে ছোট পিপড়া আছে, আজরাইলের মতো বড় ফেরেশতাও রয়েছে। তারা যদি সবাই একত্রে কোনো একটা বস্তু সৃষ্টি করতে চায়, যা আল্লাহ চান না, তা কখনো হবে না। হতে পারে না। প্রকৃত ঈমানের দাবি এটাই।
মুহতারাম দোস্ত! ঈমানের দ্বারা সেই ঈমানই উদ্দেশ্য, যা শিরকমুক্ত হবে। আমরা মুর্তির শিরক বুঝি। কিন্তু শিরক এখানেই শেষ নয়। গোপন শিরক নামেও একটি বিষয় আছে। রাসূল সা. হযরত মুয়াজকে বলেন, হে মুয়াজ তোমার ঈমানকে খালেস করো, সামান্য আমলই মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে।
হযরত আবু হুরাইরা রা. একটি হাদিস বলে খুব কাঁদতেন। তা হলো- তিন ব্যক্তি এমন রয়েছে, কিয়ামতে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ১. সেই মুজাহিদ যে নিজের বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য জিহাদ করেছে। ২. সেই দানশীল, যে সুনামের জন্য দান করেছে। ৩. সেই আলেম, যে ইলমে দ্বীন শিখেছে সুনামের জন্য।
ভাইয়েরা! মুর্তির শিরক সহজেই বুঝা যায়। ঈমানেও শিরক রয়েছে। মানুষ কোনো সমস্যায় পড়লে অন্যের দ্বারস্থ হয়। তার দ্বারা উপকৃত হওয়ার আশা করে। আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জু হয় না। এটাও শিরক। আমাদের দোয়াও শিরক থেকে পাক হতে হবে। দোয়া করার সময় যখন জবান, দিল-মন সবই আল্লাহর জাতের প্রতি নিবদ্ধ থাকে তখন কোনোভাবেই আল্লাহ তাকে কোনো মাখলুকের দিকে ঠেলে দেবেন না। তার দোয়া অবশ্যই কবুল করবেন। তাকে নিজের সাথে মিলিয়ে নেবেন। তার সব সমস্যা দূর করে দেবেন। তাকে সব পেরেশানী থেকে মুক্তি দেবেন।
মুহতারাম ভাই! যেই ঈমান এমন যে, দিল আল্লাহর দিকে নিবদ্ধ। দৃষ্টিও আল্লাহর প্রতিই ঝুঁকে থাকে। সমস্ত মাখলুক থেকে মুখ ফিরিয়ে যে আল্লাহর দিকেও দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে। দিল যখন এমন হবে- তখন আল্লাহ তাকে শিরকমুক্ত আমল করার তাওফিক দেবেন। তার দোয়া, তার ইবাদত, তার পরোপকার সবই হবে আল্লাহর জন্য। সে সামান্য সময়ের জন্যও আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। সে যেই দোয়াই করবে আল্লাহ তাআলা তার সেই দোয়াই কবুল করবেন।
মুহতারাম দোস্ত! হযরত ওমরের সময় একবার পাহাড় থেকে আগুন বেরিয়ে এলো, ওমর চিন্তা করলেন- আগুন বের হওয়া এটাও রাসূলের ভবিষ্যতবাণী। আবার আগুন তাড়িয়ে নেবে কে? সেটাও নবীর ভবিষ্যৎ বাণী। তিনি হযরত তামিমে দারীকে হুকুম করলেন, “তামিম যাও। আগুনকে তার স্থানে পৌঁছে দিয়ে এসো।” তামিম গেলেন। তার রুমালের ভয়ে আগুন ছাগলের পালের মতো দৌঁড়ে চলতে লাগলো। পাহাড়ের যেখান থেকে বেরিয়েছিল, সেখানেই ঢুকে পড়লো। তামিম তাকে বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত এখান থেকে বের হতে পারবে না। এখানেই থাকবে। তার জন্য এটা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র শিরকমুক্ত ঈমানের কারনে, অন্য কিছু নয়।
ভাইয়েরা! ওমরের খেলাফতকালে একবার হেজায থেকে এক মহিলা মদীনায় চলে এলো। লোকজন আশ্চর্য হলো। একজন ষোড়শী একাকী এলো কিভাবে? ওমর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, রাস্তা তোমার নিকট কেমন মনে হলো? সে উত্তরে বললো, রাস্তায় রাত হলে যতো বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি সবগুলো আমার নিজের বাড়ি মনে হয়েছে। আর যতো পুরুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সবাইকে আমার আপন ভাইয়ের মতো মনে হয়েছে। কেউ আমার প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকায়নি। এটা একমাত্র খালেস ঈমানের কারনে হয়েছে।
মুহতারাম ভাইয়েরা! মানুষ যখন তার বাহ্যিক জীবনকে পবিত্র করে, আবার ঈমান আমলও শিরক থেকে পাক করে, তার জন্য আল্লাহ ঘোষণা করেন, নিশ্চয়ই আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। তাকে মাফ করে দেব। তাকে অন্যের নিকটে সোপর্দ করে লাঞ্ছিত করবো না।
পক্ষান্তরে যে আল্লাহর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মাখলুকের দিকে তাকায়, অন্যের দুয়ারে ধর্না দেয়। আপন ঈমানকে লজ্জিত করে তখন আল্লাহ তাকে ভৎর্সনা করতে থাকেন- হে আমার বান্দা! তুমি এই সামান্য বস্তুর জন্য তোমার প্রিয় রব থেকে দূরে চলে যাচ্ছ। তার চেয়ে দয়ালু আর কাকে পাবে?
দোস্ত! হযরত ওমরের সময় একবার নীলনদ শুকিয়ে গেল, ওমর রা. নদীকে বললেন, “হে নীল নদ! তুমি তো আল্লাহরই সৃষ্টি। তুমি যদি আল্লাহর হুকুম মানতে বাধ্য থাক, তবে তার হুকুমে প্রবাহিত হও।” তারপর থেকে অদ্যবধি সেই নীল নদ আর শুকায়নি। সর্বদা প্রবাহমান রয়েছে। এটাই মিল্লাতে ইবরাহীমের পথ। যে কেন সমস্যা আসুক তার সমাধান একমাত্র আল্লাহ থেকেই নিয়েছেন। রাসূল সা. এমনটা করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম তার নিকট থেকে শিখেছেন। আমাদেরকেও সেই তারতিব থেকে শিখতে হবে। দ্বীনের লাইনে বেরিয়ে কাজ শিখতে হবে। আপন ঈমানকে — করার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তবেই আমরা কামিয়াব হতে পারবো।
দোস্ত! ইবরাহীম আ. -এর তারতিব ছিলÑ তিনি তাকাযা নিজে তৈরি করতেন। নিজ জান-মাল-ব্যয় করে তা পূরণ করতেন। রাসূল সা.ও তাই করতেন। মদীনার অলিতে-গলিতে ঘুরে দাওয়াত দিতেন। যারা ঈমান আনতো, তাদেরকে মসজিদে এনে তালিম দিতেন। হিসেব করলে দেখা যায়, সাহাবায়ে কেরামের বছরের চার মাস মদীনার বাইরে দাওয়াতে কাটতো। আর মদীনার মধ্যের অর্ধেক সময়ও দাওয়াতে কাটতো। এমনিভাবে তাদের জীবিকা অর্জনের সময় কমে গেল। এতে তারা এতটুকুও শঙ্কিত হতেন না। এমনকি অবস্থা এমন হলো যে, হুজুর সা. একবার নামাযে দাঁড়িয়েছেন। পেছনের সাহাবারা খিদের তাড়নায় পড়ে বেহুশ হয়ে গেছেন। নামায শেষ করে রাসূল সা. তাদের অবস্থা দেখে সান্ত্বনা দিলেন, বললেন- তোমরা যদি জানতে- এই ক্ষিধের জাযা কি হবে, তাহলে তোমরা সামান্য কষ্টও পেতে না। এতে কিয়ামতের দিন হিসাবের ভার কমে আসবে।
অনুলিখন : রোকন রাইয়ান ও আবুল কালাম আনছারী
দাওয়াতের কাজ করতে হবে তিন স্তরে
হাজী আব্দুল ওয়াহাব, পাকিস্তান
[২২ জানুয়ারি ২০১১, শনিবার, বাদ ফজর]
সব প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য। রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক রাসূল সা. এর ওপর। তাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবাদের ওপর।
আমার ভাইয়েরা! দুনিয়ার জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এই সংক্ষিপ্ত জীবনেই পরকালেরর প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। পরকালেরর জীবনের কোনো শেষ নেই। অনন্তকাল সেখানে থাকতে হবে। যদি কেউ জান্নাতী হয় তবে জান্নাতে থাকবে। আর যদি জাহান্নামী হয় তবে জাহান্নামে থাকবে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করতে হলে তিনভাবে মেহনত করতে হবে। এক. নিজের ওপর মেহনত করা। নিজের ঈমান ও আমল ঠিক করার জন্য মেহনত করা। অন্তর থেকে গায়রুল্লাহ বের করে দিয়ে আল্লাহর জাত ও সিফাতে বিশ্বাস বদ্ধমূল করা। দুই. পরিবারের ওপর মেহনত করা। পরিবারে যারা আছে তারাও যেন দীনদার হয়ে যায়।
দীন পালনের যোগ্যতা তাদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়ে যায়। তাদের মধ্যেও যেন আল্লাহর জাত ও সিফাতের বিশ্বাস চলে আসে। তারাও যেন আল্লাহর মানশা ও নির্দেশ পূরণ করতে পারে। রাসূল সা. পথ ও মত অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে। তিন. সারা বিশ্বের মানুষের জন্য মেহনত করা। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেন ঈমানওয়ালা হয়ে যায়। ঈমানের ওপর চলে আসে, সে চেষ্টা করা। তারাও যেন এ কথা বিশ্বাস করে সবকিছু আল্লাহর থেকে হয়। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছু হয় না। সমস্ত মাখলুক শিলেও আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারে না। দুনিয়ার সমস্ত মানুষ যেন আল্লাহর হুকুম রাসূল সা. এর নির্দেশনা অনুযায়ী করতে পারে এই মেহনত করা।
আমার মুহতারাম ভাইয়েরা! আমাদের নবী কোনো স্থান বা কালের ছিলেন না। তিনি সারা আলমের জন্য। অন্যান্য নবী মারা যাওয়ার পর তার মিশন সমাপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের নবী শেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো নবী আসবেন না। তাই তিনি চলে গেলেও তাঁর মিশন শেষ হয়নি। আমল শেষ হয়ে যায়নি আমাদের কাজ হয়তো এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। তবে আমাদের নিয়ত ও ফিকির হবে বিশ্ব নিয়ে। কারণ যার নিয়ত ও কর্তব্যবোধ যতো বড় হয় কাজের প্রতি তার গুরুত্ব ও গতি ততো বেশি হয়।
আমার ভাইয়েরা! দা‘য়ীর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো নিজের ওপর মেহনত অব্যাহত রাখা। কারণ নিজের নিয়ত সহীহ তো আমল সহীহ। নিয়ত ও আমল যদি সহীহ হয় তবে আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়ার জীবনের পালবেন, আখেরাতে পালবেন। তিনি আমাদেরকে জান্নাত দান করবেন। নিজের ওপর মেহনত অব্যাহত রাখলে অন্যান্য মেহনতের পথ খুলে যাবে। আমার ভাইয়েরা! কোনো কাজ শুরু করলেই তার ফল পাওয়া যায়। রাসূল সা. বলেন, কোনো বাচ্চা যদি মক্তবে যাওয়া শুরু করলেই সমুদ্র, মাছ, গর্তের পিঁপড়া পর্যন্ত তার জন্য দুআ করতে থাকে। যখন সে কুরআন তেলাওয়াত শুরু করলো। তখন আল্লাহ তাকে ও তার পিতাকে সওয়াব দিতে শুরু করেন। এজন্য ভাই এখনি আমরা নিয়ত করে নেই। অনেক দেরি করে ফেলেছি। আর বিলম্ব করা যাবে না। আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো আমরা রাসূল সা. এর উম্মত। এটাই আমাদের বড় অর্জন। অন্য কোনো অর্জন থাকবে না। মানুষ কোনো কাজের প্রতি তখনি আগ্রহ বোধ করে যখন তা নিজের দায়িত্ব মনে করে। যখন তার ভেতর কাজের প্রতি আবেগ ও ভালোবাসা, তাড়া ও তাড়না থাকে। এ জন্য আমরা দুটি দুআ করবো। একটি মুসলমানের জন্য। যেন আল্লাহ সমস্ত মুসলমানকে কাজের দিকে ঝুঁকিয়ে দেন। কাজের বুঝ দান করেন। তারা যেন এ কাজকে নিজের কাজ মনে করে। কারণ কালেমা পড়নেওয়ালা সব মুসলমানের ওপর এ কাজের দায়িত্ব রয়েছে। অপরটি হচ্ছে অমুসলিমদের জন্য। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েতের ফায়সালা করেন। যখণ আমাদের চেষ্টা, মেহনত ও দুআ একত্রিত হলে আল্লাহ রাস্তা খুলে দিবেন। তিনি নিজে কাজের প্রশিক্ষণ দিবেন। কাজ করার জন্য যতো প্রকার যোগ্যতা প্রয়োজন তা দান করবন।
আমার ভাইয়েরা! নিয়ত করে নিই। কারণ নিয়তের একটি বরকত আছে। তার প্রতিদান আছে। একবার এক বুযুর্গ মরুভূমি পার হচ্ছিলেন। মরুভূমির বালু ও বালুর টিলা দেখে তাঁর নিজ এলাকার দুর্ভিক্ষের কথা মনে পড়লো। তিনি নিয়ত করলেন হে আল্লাহ! যদি এই বালুর টিলা যদি আটা হতো তবে আমি তা দান করে দিতাম। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমপরিমাণ নেকি দান করে দিলেন। যদিও সে বালু আটা হয়নি। তিনি দানও করেননি। আমরা নিয়ত করে নিই এবং দুআ করতে থাকি। আবার দুআ করতে গিয়ে কোনো নিরাশ না হয়। দুআ করার পূর্বে ‘ইয়া জালজালালি ওয়াল ইকরাম’ পড়ে নিলে দুআ কবুল হয়। কেউ যদি দিনে পঁচিশবার ‘আল্লাহুম্মাগফিরলি লিল মুমিনিনা ওয়াল মুমিনাত ওয়াল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাত’ পড়লে আল্লাহর দরবারে তাঁর নাম মুস্তাবাতুদ দাওয়াত (যাদের দুআ নিশ্চিতভাবে কবুল হয়) হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। আমলের দ্বারাই মুমিনের জীবন সুন্দর হয়।
আমার মুহতারাম ভাই! আল্লাহ দাওয়াতের কাজ সহজ করে দিয়েছেন। যদি কোনো ব্যক্তি ইখলাসের সাথে কালেমা পড়ে তবে আল্লাহ তার জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। আর নিষ্পাপ হয়ে বান্দা যখন দুআ করে তখন আল্লাহ তা কবুল করেন। একজন বান্দা যতক্ষণ আল্লাহর রাস্তায় থাকে ততক্ষণ আল্লাহ তার সকল দুআ কবুল করতে থাকেন। কতো বড় লাভ! যদি কোনো বান্দা আল্লাহর বড়ত্বের কথা, শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলতে থাকে তখন আল্লাহ দিলে আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ বসিয়ে দেন। আল্লাহর বড়ত্ব তার অন্তরে স্থান করে নেয়। ফলে বান্দা আল্লাহর ইবাদতের জন্য অস্থির হয়ে যায়। বান্দা যখন আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস নিয়ে ইবাদত করে তখন আল্লাহ খুশি হয়ে যান। তার দুনিয়া ও আখেলাতের জীবন সুন্দর করে দেন। তাকে জান্নাত দান করেন। আল্লাহ আমাদেরকে দাওয়াতের কাজে কবুল করুন। আমীন।
অনুলিখন :: আতাউর রহমান খসরু,ইসলামি বার্তা,২০১১-০৭
দাওয়াতের কাজ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম
দাওয়াতের কাজ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম :
মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ
[২২ জানুয়ারি ২০১১, শুক্রবার, বাদ মাগরিব ইজতেমা মাঠে প্রদত্ত বয়ান]
দাওয়াত হলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম। আকীদা-মুআমালা, মু’আশারা ও আখলাক ঠিক হবে দাওয়াতের মাধ্যমে। দীন শুধু কল্পনার নাম নয়। প্রিয় নবীজী যা নিয়ে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছে তার সামগ্রিক এক চিত্রের নাম দীন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে পূর্ণ দীনের ওপর উঠিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম হলেন দীনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। উম্মত আজ জেহনী ইরতিদাদের শিকার। মুআমালা, মুআশারা, আখলাক ও দীনের অন্যান্য বিভাগে অনেকেই ইরতেদাদ-ধর্মচ্যুতিতে লিপ্ত। উম্মত দাওয়াতের কাজ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে এই অবস্থা। উম্মত যখন এই কাজ ছেড়ে দিবে তখন তারা অন্য জাতি ও ধর্মের দ্বারা মাদয়ূ-আহূত হবে। তারা ভিন জাতির তাহযীব-তামাদ্দুনের আগ্রাসনের শিকার হবে। অন্যদের কৃষ্টি-কালচারের প্রতি তাদেরকে ডাকা হবে। এই হালত থেকে নিত্য নতুন আধুনিক অনেক তরীকা বের করা হবে এবং হচ্ছে। কিন্তু উম্মাহ প্রথম যুগে যেভাবে যে কাজে ইসলাহ-সংশোধন হয়েছে বর্তমান যুগেও সেভাবেই ইসলাহ হবে। অন্য কোন তরিকায় হবে না অবস্থার পরিবর্তন। এই ফিকির ও ভাবনা ঠিক নয় যে দাওয়াতে কাজ শুধু নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামের যুগের জন্য সীমিত ছিল। মূলত নবীওয়ালা এই কাজ সর্বকালের সবার জন্য। কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য। উম্মত যদি সম্মিলিতভাবে এই কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। সম্মিলিতভাবে নয় যদি ব্যক্তিগতভাবেও এ দাওয়াত ছেড়ে দেয়া হয় তাহলেও উম্মতের ক্ষতি হবে অপূরণীয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত কা’ব ইবনে মালেক রাযি. এর জীবনে। তিনি যদিও বদরী সাহাবী ছিলেন না, কিন্তু গাযওয়াতে তাবুকে তিনি যেতে পারেননি। এ ঘটনা প্রসিদ্ধ। এই না যাওয়ার কারণে পঞ্চাশ রাত তাঁর জীবনে নেমে আসে দুঃখের ছায়া। তার ও তার দু’সাথীসহ দুঃখের মাঝে দিন কাটান। জমিন প্রস্তুত হওয়ার পরও তাদের জন্য হয়েছিল সংকীর্ণ। পুরো মদীনাবাসী তাদের বয়কট করেছিল। সালামের উত্তর দিত না। এ সময় গাস্সানের বাদশা তাঁর নামে রেশমের কাপড়ে পত্র পাঠিয়ে তাঁকে দাওয়াত দেয় যে, তোমার সাথী তোমার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছে। আমাদের পথে এসো। তিনি এই পত্র আগুনে জ্বালিয়ে দেন এবং বলেন, এক মুসিবত শেষ হওয়ার আগেই আরেক মুসিবত এসে হাজির।সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে গাস্সানের বাদশা দাওয়াত দিলো। এ ঘটনা কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য আমাদের জন্য শিক্ষা। দাওয়াত ছেড়ে শুধু আমল করলে দীনের হেফাজত হবে না। দীনের ওপর ইস্তেকামাত ও দীনের হেফাজত নির্ভর করে অন্যকে দাওয়াত দেয়ার ওপর, দীনের হেফাজত দাওয়াতের ওপর নির্ভরশীল। দাওয়াত না দিলে, বাতিলশক্তি এই উম্মতকে অন্য দিকে দাওয়াত দিবে।প্রিয় দোস্ত ও আযীয! ঈমান শিখতে হয়, ঈমানের মজলিস কায়েম করতে হয়। দাওয়াতের কাজে বুনিয়াদী সিফাত হলো ঈমানের সিফাত। কুরআন হাদীসে মুমিনকে দাওয়াত দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম ঈমানের মজলিস কায়েম করতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. অন্য সাহাবীকে দাওয়াত দিয়ে বলতেন, এসো আমরা ঈমান আনি। অর্থাৎ ঈমানের আলোচনা করি। ঈমানের প্রতি দাওয়াত দেয়া প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব, মুমিনের কাজ। প্রত্যেকেই অন্য কিছুর আলোচনা ছেড়ে আল্লাহ তাআলার জাত ও সিফাত, তাওহীদ ও আল্লাহর বড়াইয়ের দিকে দাওয়াত দিবে। মজার বিষয় হলো, একজন আমাকে প্রশ্ন করলেন, ঈমানেরও কি আবার মজলিস হয়? এই মজলিস দ্বারা কি ঈমান শক্তিশালী হয়? ইমাম বুখারী রহ. ঈমান শক্তিশালীকরণ বিষয়ে অধ্যায় সংযোজন করেছেন। হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. অন্য সাহাবীকে দাওয়াত দিতেন। তাঁর মা’মুল ছিল তিনি বলতেন, এসো ঈমান আনি। এসো ঈমানের তাজদীদ-নবায়ন করি। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ঈমান আন। অর্থাৎ ঈমান বৃদ্ধি কর। মূলত ঈমান অনুযায়ী ইতাআত-আনুগত্য হবে। দেল হলো ঈমানের জায়গা। কালেমার মেহনতের জায়গা। আমরা অনেকেই মনে করি, কালেমার দাওয়াত শুধু অমুসলিমদের জন্য। এ ধারণা ঠিক নয়। মুমিনদেরকেও কালেমার দাওয়াত দিতে হবে। আজ সর্বত্র আল্লাহর বড়ত্ব ও কুদরত ছাড়া বস্তুবাদী মাদ্দিয়াতের আলোচনা। আমাদেরকে বস্তুবাদী আলোচনা ছেড়ে আল্লাহর কুদরতের আলোচনা করতে হবে। এক সাহাবীকে রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, সকাল কিভাবে কাটিয়েছ? তিনি বললেন, ঈমানে হকের সাথে, সঠিক ঈমানের সাথে। তিনি বললেন, এর আলামত কী? তিনি বললেন, আরশ কুরসী আমার সামনে, কিয়ামতের বিষয়াদি আমাদের সামনে। আমার রূহকে দুনিয়া থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আখেরাতমুখি করেছি। নবীজী বললেন, তুমি ঈমানের পরিচয় পেয়েছ। এর ওপর অটল থাক। মূলত ঈমান এভাবে ছুটে যায় যেমন ছুটে যায় লাগামহীন উট। আমরা যেমন জামা খুলে ফেলি, ঈমানও তেমনিভাবে খুলে যায়। আমাদের ঈমানের আলোচনা বাড়াতে হবে, গালেব রাখতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম ইলমের হালকা কায়েম করতেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. ইলমের হালকা কায়েম করে অন্যকে দাওয়াত দিতেন এবং বলতেন, মসজিদে নবীজীর মিরাস বণ্টন হচ্ছে, আর তোমরা বাজারে? উম্মতকে সাহাবায়ে কেরাম যুহদ ও মেহনতের কথা বলে ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে। আমাদের দাওয়াতের উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ার নানা পরিবেশ থেকে ঈমানের পরিবেশে আনা। যেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর আলোচনা থাকবে না। বস্তুবাদী নকশা ছেড়ে ঈমান বিল গায়েবের বিষয়ে দাওয়াত দেয়া। বেঈমানরা আল্লাহকে ছেড়ে কায়েনাত-চীজ ও আসবাবকে আল্লাহর জাত মনে করেছে। আর মুমিনরা কায়েনাতকে নয়, আল্লাহর আহকামকে আল্লাহ পাওয়ার মাধ্যম বানায়। লা ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. এই কালেমার দাওয়াতের উদ্দেশ্য হলো, করণেওয়ালা জাত একমাত্র আল্লাহ। দুনিয়ার নকশা নয়। নবীজীর তরিকাই হল কামিয়াবীর একমাত্র পথ। যারা ঈমান রাখে না, তারা দুনিয়াকে আল্লাহর জাত মনে করেছে। তারা হুকুমতকে সম্মানের মাধ্যম বানিয়েছে। দোকানকে মাধ্যম বানিয়েছে লাভের। ঔষধকে বানিয়েছে আরোগ্যের। এটা আল্লাহর নেযাম নয়। আল্লাহর জাবেতা-নীতির কোন পরিবর্তন নেই। আল্লাহই সব করেন। দুনিয়ার মামুলী জিনিসের জন্য আল্লাহর হুকুম ছেড়ে দেয়া এ যুগের মুসলমানদের জন্য কোনো বিষয়ই নয়। আল্লাহর হুকুমকে মানতে হবে তাহলেই আল্লাহর নুসরত আসবে। আল্লাহর জাবেতা হল আল্লাহর আহকাম। আল্লাহর জাবেতা কায়েনাত নয়। এটা হলে এমন হতো না যে, সূর্য আছে কিন্তু আলো নেই, স্ত্রী আছে কিন্তু সন্তান হচ্ছে না, দোকান আছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না। এ বিষয়গুলো বোঝায় যে, করণেওয়ালা জাত একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহর জাত থেকে সরাসরি ফায়দা পাওয়ার জন্য আল্লাহর হুকুম পালন করতে হবে। তাহলেই নুসরত আসবে। আসবাব বানানো আমাদের কাজ নয়। কাজ বানানেওয়ালা আল্লাহ তাআলা। অনেকেই ধারণা করেন, আমাদের কাজ হলো আসবাব, আল্লাহর কাজ হচ্ছে সাহায্য করা। এ ধারণা ঠিক নয়। হাদীসের প্রসিদ্ধ ঘটনা, তিন ব্যক্তি এক গুহায় আটকে যায় পাথরে মুখে এসে পড়ায়। তারা সম্মিলিত আমলের মাধ্যমে মুক্তি পায়। তারা তিন লাইনে আমল করেছে। একজন মায়ের সাথে সদাচরণ করেছিল, একজন চাচাতো বোনের সাথে অবৈধ কাজে লিপ্ত হওয়ার মুহূর্তে আল্লাহর ভয়ে বিরত থেকেছিল, অন্য একজন শ্রমিকের পারিশ্রমিক জমিয়ে রেখে আদায় করেছিল। এই ইহসান ও আখলাকের কারণে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। পাথর হটিয়ে দেন। বুঝা গেল, আল্লাহর হুকুমের মাধ্যমে সাহায্য আসে। আল্লাহর সাহায্য ও নুসরাত নবী ও সাহাবায়ে কেরামের সাথে নির্ধারিত নয়। সাহায্য নেওয়ার নীতিমালা সকলের জন্য একই। দোস্ত আহবাব! ঈমান কী? এ বিষয়ে রাসূল সা. জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন, তোমার নেককাজ যদি তোমাকে খুশি করে, অসৎকাজ যদি তোমাকে পেরেশানে ফেলে, তাহলে তুমি মুমিন। আমরা মনে করি, আমরা ঈমানদার। অথচ আমাদের আমল, আমাদের আখলাক, আমাদের ইবাদত, আমাদের মুআমালা, আমাদের মুআশারা ঈমানের খেলাফ। এক সাহাবীর পক্ষ থেকে নবীজীর দরবারে গীবত হয়ে গেল। নবীজী বললেন, তুমি কুরআনের খেলাফ করলে। যে ব্যক্তি কুরআনের হারামকে হালাল ভাববে। সে কুরআনের খেলাফ করল। আমাদেরকে কালেমার ইখলাস হাসিল করতে হবে। ঈমান ও ইখলাস একই। কালেমার ইখলাস হলো হারাম থেকে বিরত থাকা। ঈমান হল উটকে লাগাম লাগানোর মতো। এর দ্বারা উটকে যেভাবে ইচ্ছা পরিচালনা করা যায়। অনুরূপ মুমিন ঈমান দ্বারা পরিচালিত হবে। নামাযের জন্য আমরা যেমন শরীর পাক করি, অযু- গোসলকে জরুরি মনে করি, অনুরূপভাবে আমাদের শরীরকে হারাম থেকে বিরত রাখতে হভে। শরীরের রক্তকে হালাল দ্বারা পাক করতে হবে। গাড়ী পরিচালনার জন্য যেমন পরিচ্ছন্ন ডিজেল ও মবিল প্রয়োজন, অনুরূপ জীবনের গাড়ি পরিচালনার জন্য হালাল খাবার প্রয়োজন। আমাদেরকে মুআমালাত ঠিক করতে হবে। আমাদের মুআমালাত যদি অন্য জাতির ন্যায় হয় এবং ইবাদত হয় নবীজীর তরীকায় তাহলে আমাদের উন্নতি হবে না। নামাযের জন্য যেমন তাহারাত জরুরি, অনুরূপ মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে আহকামের ওপর আমল করা জরুরি। হারাম রক্তের কারণে আমাদের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, দেল খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দেল দ্বারা রক্ত প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। তাই সারা শরীর চলে আল্লাহর হুকুম ছাড়া। হালাল খানার মাধ্যমে আমাদের শরীরের রক্তকে পরিশোধিত করতে হবে।এই যুগে সাহাবায়ে কেরামের মতো ঈমান সৃষ্টি করতে হলে আমাদেরকে হায়াতুস সাহাবা তালীম করতে হবে। যারা সময় লাগিয়েছেন বা এ কাজকে মহব্বত করেন, তাদেরকে অবশ্যই হায়াতুস সাহাবা ও মুন্তাখাব আহাদীস তালীম করতে হবে। হযরতজী ইউসুফ রহ. কে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার পরে এ কাজ কীভাবে চলবে- এর একটি রূপরেখা তৈরি করে দিন। তিনি বললেন, এ কাজের নমুনা আমি নই, এ কাজের নমুনা হচ্ছেন সাহাবায়ে কেরাম। তাই তিনি একটি হায়াতুস সাহাবা সংকলন করেছেন। এই কিতাব তালীম করলে ঈমান শক্তিশালী হবে। উম্মত বুঝবে ঈমানের হাকীকত। ঈমানের দাবীতে নিজকে গড়তে পারবে। দীনের দাওয়াত নিয়ে ঘোরাফেরা করা সাহাবায়ে কেরামের কাজ। সকল উম্মতকে তাদের অঙ্গনে দাওয়াতের কাজ করতে হবে। দুনিয়ার কোনো প্রান্তে যদি আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন হয়, তাহলে তার মুকাবেলায় সকলকে কাজ করতে হবে। যেমন- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. বলেন, যদি কোনো গ্রাম আল্লাহর কোনো হুকুম ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে তাদের সাথে কিতাল ও লড়াই করতে হবে। এক হুকুমের জন্য হযরত আবু বকর রা. মদীনাকে খালি করতে চেয়েছিলেন। নবীজীর ওফাতের পর যাকাত দিতে যারা অস্বীকার করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে তিনি বলেছিলেন, তারা যদি যাকাতের প্রাণীর রশি দিতেও অস্বীকার করে তাহলে আমি আবু বকর তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। দীনের ক্ষতি হবে আর আমি আবু বকর জীবিত থাকবো! তারা মূলত পূর্ণ হুকুম অস্বীকার করেনি। আংশিক হুকুম অস্বীকার করার কারণে আবু বকর রা. মদীনা খালি করতে চেয়েছিলেন। জিন্দেগীতে ঈমান আনার জন্য সাহাবায়ে কেরামের তরিকাই কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে, আমাদের চালচলন ও নকল হরকত যদি সাহাবায়ে কেরামের মতো না হয় তাহলে হেদায়েত আসবে না, নুসরত আসবে না। আর সাহাবায়ে কেরামের ঈমান আখলাক-ই হলো মূল। মুহতারাম দোস্ত! আমাদের ভুল হলো সাহাবায়ে কেরামের নকল ও হরকতকে অনেকেই সে যুগের সাথে সীমিত করে ফেলে এবং আল্লাহর সাহায্যের বিষয়টিকে কেবল কিতালের সাথে সম্পৃক্ত মনে করে। এটি একটি মারাত্মক ভুল। উম্মতের কারণে জুমুদ ও জড়তা বিরাজ করছে এ কারণেই। সাহাবায়ে কেরামের নকল ও হরকত ও দাওয়াতী কাজকে কিয়ামত পর্যন্ত চলবে এটা মনে করতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে আল্লাহর সাহায্য পেয়েছেন, তা এ যুগেও পাওয়া যাবে। নবীজী বলেছেন, তোমাদের পরবর্তীতে আগত একজন মুমিনের মদদ, তোমাদের দশজনের ন্যায় হবে। অন্য হাদীসে এসেছে আমার পরবর্তীতে আগত একজন মুমিনের আমলের আজর ও বদলা তোমাদের পঞ্চাশজনের মতো হবে। এ সকল ওয়াদা ও নুসরত তখনই হবে, যখন উম্মত সাহাবায়ে কেরামের মতো কাজ করবে। দাওয়াতের কাজ নিয়ে মহল্লা থেকে ফিরবে পৃথিবীর পথে পথে।
অনুলিখন :: মাওলানা লাবীব আব্দুল্লাহ,ইসলামি বার্তা ২০১১,০৭
কার্গুজারী-৫
তাবলিগী সফর:
শরীফ মুহাম্মদ,ইসলামি বার্তা ২০১২
সতের বছর বয়স তখন। ফরিদাবাদ মাদরাসায় পড়ি। শরহে বেকায়া জামাতে। এ বছরেই এক সময় হঠাৎ বন্যার পদধ্বনি শোনা যেতে লাগলো। একেকদিন একেক জেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। খবর আসছে পত্র-পত্রিকায়। ঢাকার চারপাশে বন্যা। দেখতে দেখতে বুড়িগঙ্গাও যৌবন পেয়ে গেছে। ফুঁসে উঠে ড্রেন-নালা, খাল-ক্যানেল দিয়ে ঢাকা ঢুকে পড়ছে তার পানি।
একদিন ফজরের পর মাদরাসার ভেতরের ড্রেন দিয়ে দেখলাম একটু একটু পানি উঠছে মাঠে। উদ্বেগ ও আতঙ্কের চেয়ে উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য বোধ করলাম বেশি। কম বয়সের কারণে ও মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা হলে ছুটি প্রাপ্তির ঘোরে বন্যার ক্ষতিকর দিকটি মাথাতেই এলো না প্রথমে। ওই দিনই সকাল দশটার দিকে মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হলো। বলা হলো, যারা তাবলিগে যাবে, তারা যেন নাম লিখিয়ে দেয়। বুঝে না বুঝেই নাম দিয়ে দিলাম। এরপর দুপুরের আগে কাকরাইল ও বিকেলের মধ্যে আদমজী জুট মিলে।
তাবলিগ জামাতে সময় লাগানোর আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। তিনদিনের জামাত। কাকরাইল থেকে পাঁচ-ছয়জন যুক্ত হলেন। বাকিরা ছিলাম এক মাদরাসারই বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্র। এ ছিল অন্য রকম নিমগ্নতায় কৈশোরের শেষবেলা। আদমজী জুট মিলে থাকতে থাকতেই খবর পেলাম বন্যায় ডুবে যাচ্ছে সারাদেশ। উদ্বেগ চেপে বসলো। নিজেদের বিপন্নতার আশঙ্কার পাশাপাশি অন্যদের দুর্ভোগ ও অসহায়ত্ব নিয়েও মন খারাপ হতে লাগলো। তিনদিন শেষ হওয়ার পর যখন জামাতসহ বাসে ফিরছি তখন যাত্রাবাড়িতে এসে আমাদের মাদরাসার দলটি নেমে পড়লাম। নেমেই দেখলাম, চারদিকে পায়ে হাঁটা মানুষের স্রোত। ফরিদাবাদ পর্যন্ত যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। রাস্তাই নাকি নেই। চমকে উঠলাম। সেটি ছিল সেই আটাশির বন্যা।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই পোস্তগোলার দিকে গাট্টি-বোঁচকা মাথায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। জায়গায় জায়গায় দেখলাম, বালি ও সিমেন্টের বস্তা এনে সাধারণ মানুষ রাস্তার উপর ফেলছেন। উপরের অংশের পানি যেন এই নিম্নাঞ্চলে চলে না আসে সেজন্য রাস্তা এক পর্যায়ে আটকে দিয়ে হাজার হাজার মানুষ খাঁটাখাঁটুনি করছেন। পোস্তগোলায় যাওয়ার সময় রাস্তা থেকে বায়ে নেমে ম্যাচ ফ্যাক্টরির সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেলাম। দলবদ্ধ মানুষের স্রোতের সঙ্গে। এরপর পোস্তগোলা থেকে ফরিদাবাদে গেলাম কোমর সমান পানিতে ডুবে। একটি ভ্যানে সামানা তুলে তার চারপাশে ছিলাম আমরা। মাদরাসায় পৌঁছলাম সন্ধ্যার আগে। এরপর চারদিক ভুতুড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ফাঁকা মাদরাসায় সারারাত আমরা ক’জন ভয়ে ভয়ে কাটালাম। প্রাণভরে দুআ করলাম। নিজেদের বাড়িঘর ডুবে যাওয়া, বাসা বাড়িতে যেতে না পারার দুশ্চিন্তা নিয়ে অস্থির হয়ে আল্লাহর দরবারে কাঁদলাম।
পরদিন সকালে প্রথমে সদরঘাট ও পরে কমলাপুরে গিয়ে হাজির হলাম। একটা ট্রেন পেতে পেতে দুপুর ও ময়মনসিংহে গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা। ট্রেন থেকে নেমে বাসায় যাওয়ার পথে দেখলাম ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের প্রান্ত ছুঁয়ে আছে ব্রহ্মপুত্রের পানি। কোনো কোনো জায়গায় রাস্তা কিছুটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে আছে। রিক্সাচালককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, গত দু’দিন একটু একটু করে পানি চুয়ে চুয়ে শহরে ঢুকছিল। আজ বন্ধ। আজ থেকে বরং পানি একটু একটু কমছে। বাসায় গিয়ে পৌঁছার আগেই প্রশান্তি এসে ঠাঁই পেল মনে।
এরপর যখন বাসায় পৌঁছলাম তখন মনে হলো, বড় কোনো বিপর্যয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর আবার যেন পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে। আল্লাহ তাআলার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় হৃদয়-মন আপ্লুত হয়ে গেল। জীবনে প্রথম তাবলিগের সফরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল গভীর উৎকণ্ঠার ঘটনা। আবার সফর শেষের সঙ্গে ছিল প্রশান্তির অভূতপূর্ব অনুভূতি। এ উদ্বেগ ও প্রশান্তির কলকাঠি আমার হাতে ছিল না। ছিলাম কেবল ফলভোগী। আল্লাহ তাআলার কাছে আত্মসমর্পণ ও সাহায্য চাওয়ার সবক শেখায় তার দীনের মেহনত। এই মেহনতে নিমগ্নতার একটি প্রধান উপায় তাবলিগ জামাত। এ জামাতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আল্লাহ তাআলা সবাইকে দান করুন।
হিকমতের মাধ্যমে দাওয়াত
হিকমতের মাধ্যমে দাওয়াত
হলিউড বাংলা,মঙ্গলবার, ১৮ জানুয়ারী ২০১১
মাওলানা ফয়সল আহমদ জালালী : ঢাকা থেকে : দাওয়াত ইলাল্লাহর উত্তম একটি তরিকা হলো তাবলিগ জামাত। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এ দাওয়াতি কাজ। ব্যাপক হারে এ দাওয়াতি কাজ মুসলিম সমাজে সমাদৃত হয়েছে। এ যেন আল্লাহ তায়ালার নিোক্ত আয়াতের বাস্তব এক নমুনা। ইরশাদ হচ্ছেঃ ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে মানুষকে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা আহ্বান করো এবং তাদের সাথে আলোচনা করো উত্তম পন্থায়। (নাহলঃ ১২৫)
হিকমতের মাধ্যমে আহ্বানঃ এমন উপযোগী বাক্য চয়ন করে দাওয়াত প্রদান করো যা মানুষের মনে স্থান করে নেয়। অন্য কথায় এমন প্রজ্ঞার সাথে দাওয়াত দানকে হিকমত বলে, যার সাহায্যে দাঈ মানুষের অবস্থার তাগিদ জেনে নিয়ে তদনুযায়ী কথা বলে। সে এমন সময় ও সুযোগ খুঁজে নেয়, যা মানুষের ওপর বোঝা না হয়। নম্রতার স্থলে নম্রতা ও কঠোরতার স্থলে কঠোরতা অবলম্বন করে। স্পষ্টভাবে কথা বললে যদি মানুষ লজ্জিত হবে বলে দাঈ মনে করে তাহলে সেখানে ইঙ্গিত করে কথা বলে। ব্যস্ত থাকলে ফারিগ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, অতঃপর দাওয়াত প্রদান করে। যাতে দাওয়াতের লক্ষ্য ব্যক্তি বিরক্ত না হয় এবং তার মাঝে একগুঁয়েমির ভাব অব্যাহত না থাকে। (তাফসিরে রুহুল বায়ান) আল্লামা ইলিয়াস র. প্রবর্তিত তাবলিগ জামাতের দাওয়াতে হিকমতের এ মর্মবাণী পরিলক্ষিত হয়।
মাওইজায়ে হাসানা- সদুপদেশ দ্বারা দাওয়াতঃ মানুষের অন্তর গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয় এবং সে লক্ষ্যে মন নরমও হয়, এমন পন্থায় দাওয়াতের উপস্থাপনাকে মাওইজায়ে হাসান বলা হয়। উদাহরণ তার কাছে কবুল করার সাওয়াব ও উপকারিতা এবং কবুল না করার শাস্তি ও অপকারিতা তুলে ধরা।
তাবলিগ জামাতের দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য ও জোরালোভাবে লক্ষণীয় উত্তম পন্থায় আলোচনাঃ দাওয়াতের কাজে যদি কোথাও তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন দেখা দেয় সেখানেও তা উত্তম পন্থায় হওয়া দরকার। উত্তম পন্থার মানে হচ্ছে কথাবার্তায় নমনীয়তা অবলম্বন করতে হবে। এমন যুক্তিপ্রমাণ পেশ করতে হবে যাতে মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হয়। সুপ্রসিদ্ধ ও সুবিদিত বাক্যাবলির মাধ্যমে প্রমাণ দিতে হবে যাতে মানুষের সন্দেহ দূরীভূত হয় এবং হঠধর্মিতার পথ পরিহার করে।
এ নীতি কেবল মুসলিমদের দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে সম্পর্কযুক্ত নয়, বরং অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কেও তা প্রযোজ্য।
ফিরাউনের মতো পাষণ্ডের সাথেও নম্র আচরণের নির্দেশ ছিলঃ মুসা আঃ ও তাঁর ভাই হারুন আঃকে আল্লাহ তায়ালা ফিরাউনের প্রতি পাঠিয়ে তার প্রতি দাওয়াত দানের সময় কোমল আচরণ করতে বলেছিলেন। ইরশাদ হয়েছেঃ ‘তোমরা দু’জন ফিরাউনের কাছে যাও, সে তো সীমা লঙ্ঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে। (সূরাঃ ত্বহা, আয়াত-৪৩-৪৪)
মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করার এ তিনটি মূলনীতি অবলম্বন করেই তাবলিগ জামাতের দাওয়াত পরিচালিত হচ্ছে। এখানে কোনো বাড়াবাড়ি নেই, ছাড়াছাড়িও নেই।
তাবলিগ জামাতে কোনো একগুঁয়েমি নেইঃ যেহেতু এটি একটি খালিস দাওয়াতি কর্মপন্থা। ফলে এখানে লক্ষ করা হয় কিভাবে পথভোলা মানুষকে আল্লাহ্মুখী করা যায়। কোনো একক নীতি এখানে মুখ্য বিষয় নয়। এর ফলে বিশুদ্ধতার স্বার্থে কিংবা স্থান-কাল-পাত্রের চাহিদায় এতে সংশোধন ও সংযোজন করা হয়। তাবলিগ জামাতে যে গ্রন্থটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় তার নাম এক সময় ছিল তাবলিগি নিসাব। বর্তমানে একে ফাজায়েলে আমল বলা হয়। এক সময় শুধু এ গ্রন্থটিকেই পাঠ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বর্তমানে মুনতাখাবে হাদিস পুস্তিকা ওয়াহিদ এলাজ ইত্যাদিও পাঠ করা হয়। আরবি ভাষাভাষীদের জন্য হায়াতুস সাহাবাও পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এক সময় বলা হতো তাবলিগের ছয়টি উসুল। এর ফলে কিছু সমালোচক বলত ইসলামের মূল ভিত্তি পাঁচটি, কিন্তু তাবলিগিরা বাড়িয়ে তা ছয়টি বানিয়েছেন। মূলত এটি সমালোচনার কোনো বিষয় নয়। এটিকে ইসলামের ভিত্তি বলে কেউ কোনো দিন দাবিও করে না। বলা হয়, এ ছয়টি জিনিসের ওপর যত্নবান হলে দ্বীনের ওপর চলা সহজ। এক সময় একে উসুল বলা হতো, কিন্তু এখন একে ছয়টি সিফাত বা গুণ বলা হয়। এক সময় দায়িত্বশীলকে বলা হতো আমীর এখন বলা হচ্ছে জিম্মাদার। এমনকি এখন শূরা পদ্ধতিকে অনুসরণ করা হচ্ছে।
তাবলিগ জামাত শিরক বিদআতমুক্তঃ শিরক ও কুফরের বিরুদ্ধেই তাবলিগ জামাতের দাওয়াত। মুসলিম বলতে সবাই শিরকমুক্ত থাকতে চায়, কিন্তু অজ্ঞতা ও অসাবধানতাবশত অনেক সময় শিরকের কাজ করে বসে। দলীয় প্রধান বা মুর্শিদের প্রতি যেভাবে মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখানো হয় তা অনেকটা আল্লাহকে তাজিম করার মতো, যা শিরকের নামান্তর। কিন্তু তাবলিগ জামাতে আমীর ও সাধারণ একাকার। একই ধরনের খানা সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে। নেই এখানে আমীর-ফকিরের কোনো ভেদাভেদ। এ যেন রাসূলুল্লাহ সাঃ ও সাহাবায়ে কেরামের সোনালি জমানার এক জীবন্ত নমুনা। এখানে সেবক ও সেবিত বলতে কেউ নেই, সবাই খাদিম আর সবাই মাখদুম। একজন রাজকীয় হালে সাজানো খাঞ্জায় বসে মুরগির রান টানবে আর একদল খাদিম তা সরবরাহ করার জন্য তটস্থ থাকবে, এ ধরনের দৃশ্য তাবলিগ জামাতে নেই।
তাবলিগ জামাতে কোনো পরনির্ভরতা নেইঃ আল্লাহর দেয়া জান ও মাল তাবলিগ জামাতে ব্যয় করতে পরামর্শ দেয়া হয়। অপরের মালের প্রতি এতে লোভ আসে না। সাথীদের অবস্থা বিবেচনা করে দৈনিক টাকা উঠানো হয় এবং সে অনুপাতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অপরের কিছু খাওয়ার সুওয়াল নেই, সুওয়ালের কোনো ভানও করতে নেই।
দাওয়াতে তাবলিগে কোনো ব্যক্তিনির্ভরতা নেইঃ তাবলিগ জামাতের সব কাজ শূরার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এখানে ব্যক্তিপূজার কোনোই অবকাশ নেই। হজরতের মুখ দিয়ে যা বের হবে তা সবাইকে মানতে হবে, এমন কিছু নেই তাবলিগ জামাতে। মাশওয়ারার ভিত্তিতে জিম্মাদারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা আসে তা মান্য করাই কামিয়াব রয়েছে বলে শেখানো হয়। প্রকৃত অর্থে এটিই ইসলামের শিক্ষা। এতেই রয়েছে সফলতা।
পার্থিব মোহমুক্ত একটি অনুপম দাওয়াতি ধারাঃ সব ধরনের কৃত্রিমতাবর্জিত সুন্নাহ সমর্থিত একটি আদর্শ দাওয়াতি ধারা হলো তাবলিগ জামাত। এতে পার্থিব কোনো মোহ দৃশ্যমান নয়। হাদিয়া-তুহফা আদায়ের কোনো কৌশলী ব্যবস্থাও নেই এখানে। আজ ইসলামের নামে যা চলছে, খানকাহ, দরগাহ পীর-মুরিদীর নামে যে ব্যবসা চলছে; তা দেখে বিজাতীয়রাও লজ্জা পায়। অথচ তাবলিগ জামাতের লোকদের চলাফেরা, আচার-আচরণ দেখে বহু বিধর্মী ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছে। ইসলামের সুমহান বাণী, এর কৃষ্টিকালচার দেখে বিমুগ্ধ হয়ে অনেক অমুসলিম অভিযোগ করছে, কেন আমাদের কাছে আগে এ দাওয়াত পৌঁছানো হয়নি। মুসলিম না হওয়ার ফলে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে শাস্তির সম্মুখীন হবে, এর জন্য দায়ী কারা? ছোটখাটো বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা সব ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক। কিন্তু সার্বিকভাবে তাবলিগ জামাতের কাজকর্ম ও দাওয়াত ইলাল্লাহর পদ্ধতি জমহুর উলামায়ে কিরাম নির্ভেজাল বলে মনে করেন। আল্লাহর পথে নিবেদিতপ্রাণ মুরব্বিদের পরামর্শই হলো তাবলিগ জামাতের কর্মপদ্ধতি। এসব মুরব্বির খালিস নিয়ত ও তাকওয়া প্রশ্নাতীত। এ কারণে তাবলিগ জামাতের দাওয়াতে যেভাবে মানুষ আল্লাহর পথে উঠছে; অন্য কোনো তরিকায় সেভাবে দেখা যায় না।
বিশ্ব ইজতেমা মুনাজাতসর্বস্ব না হওয়া চাইঃ বিশ্ব ইজতেমার সময় একটি শব্দ খুবই আলোচিত হয়। তা হলো আখেরি মুনাজাত। এতে অংশগ্রহণের জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ইজতেমা ময়দানের চার পাশে ভিড় করে। এ দিন চতুর্দিক থেকে কত মানুষ যে অংশগ্রহণ করে তার কোনো হিসাব নেই। পরিসংখ্যান করতে যারা নিয়োজিত তারা কেবল বড় বড় প্রবেশ পথগুলো দেখে জরিপ চালায়। কিন্তু চারপাশের অলিগলি এবং তার এক্সটেনশন যে কত দূর বিস্তৃত তা দেখবে কে?
জনস্রোত না জনসমুদ্র, কোনো শব্দ দিয়েই মনে হয় এ মহামিলনকে ব্যক্ত করা যাবে না। এ তো হলো সাধারণ মুসলিমের কথা। এর সাথে রয়েছে বড় বড় রাজনৈতিক দলের বড় নেতাদের অংশগ্রহণের বিষয়। দলবল নিয়ে তারাও সেখানে উপস্থিত হন আখেরি মুনাজাতে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, এটি ভালো কাজ। কিন্তু কেবল মুনাজাতে অংশগ্রহণই মুখ্য হওয়া উচিত নয়। মুনাজাতের আগে বিশ্বমানের মুরব্বিরা যে বয়ান দেন তা মনের কান দিয়ে শুনলে বড় ভালো হতো। সে মতো চললে দেশ ও জাতির বড়ই উপকার হতো। সে আলোকে রাষ্ট্রপরিচালনা করলে ফিরে আসত খেলাফতে রাশেদার সোনালি যুগ। এ খাতে সে খাতে দেশ হতো না দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। ধনী-দরিদ্রের পাহাড়সম বৈষম্য থাকত না মানবসমাজে। আশা করি আমাদের নেতানেত্রীরা সে দিকে নজর দেবেন। মুনাজাতে অংশগ্রহণকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন না। দেশ ও দল পরিচালনায় ইসলামের ধারে কাছেও নেই অথচ বিরাট বহর নিয়ে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করে দেখালাম আমিও ইসলামের পথে আছি। কপটতা আর কাকে বলে! রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করলে জনগণ যেভাবে উপকৃত হয় অন্য কোনোভাবেই ততটুকু হয় না। আল্লাহর কাছে করজোড়ে দোয়া করি আল্লাহ আমাদের নেতানেত্রীদের সুমতি দান করুন। বিশ্ব ইজতেমাকে আল্লাহ তায়ালা গোটা উম্মাহর হেদায়াতের জন্য অছিলা হিসেবে কবুল করুন।
মনে রাখবেন, ‘আখেরি মুনাজাত’ বলে তাবলিগের মুরব্বিদের মুখ থেকে কোনো কিছু শোনা যায়নি। লোকমুখে এবং মিডিয়ায়ই এ শব্দের প্রয়োগ বেশি।এর জন্য কোনো ঘোষণাও করা হয়নি। তা সঙ্গতও নয়। আগেই বলেছি, তাবলিগ জামাতে কোনো বিদআত-আশ্রয়ী কাজ করা হয় না। এ দোয়া মূলত করা হয় আল্লাহর রাস্তায় যেসব জামাত রওনা করে তাদের কামিয়াবির লক্ষ্যে, উম্মতের হেদায়াতের লক্ষ্যে।
আমরা যারা মুনাজাতে অংশগ্রহণের জন্য উদগ্রীব, যদি আমরা জামাত-বন্দী হয়ে যেতাম তাহলে প্রকৃত দোয়ার উপযুক্ত আমরাও হয়ে যেতাম। হেদায়াতের নূর আমাদের ওপরও চমকাত। আল্লাহ আমাদের হেদায়াত দান করুন। মুনাজাতসর্বস্ব বিশ্ব ইজতেমা কারো কাম্য নয়। হেদায়াতমূলক বিশ্ব ইজতেমা কতই না ভালো!
বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণজমায়েতে ও আখেরি মুনাজাত বলতে কিছুই নেইঃ আরাফাতের মাঠে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। একেই হজের প্রধান অনুষ্ঠান বলে। এ অনুষ্ঠানটি আমি সব সময়ই দেখে থাকি। এবারকার অনুষ্ঠানটি দেখার পর আমার মনে জাগল, এ দিনটি সর্বশ্রেষ্ঠ দিন, এটি সবচেয়ে পবিত্র স্থান। এখানকার দোয়া কবুল হয় না বলে মনে করাও গোনাহের কাজ। বয়ান শেষে ইমাম সাহেব সালাত আদায় করলেন; অতঃপর সবাই উঠে রওনা করলেন। কোনো মুনাজাতের আয়োজন নেই। ভাবলাম সবাই মিলে মুনাজাত করলে কত কান্নার রোল পড়ত। আল্লাহ তায়ালা কবুল করতেন। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা এলো রাসূলুল্লাহ সাঃ এরূপ করেননি বলেই হয়তো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
আমাদের সব কর্মকাণ্ড ওয়াজ-নসিহত সুন্নাহ মোতাবেক হওয়া চাই। তাবলিগের মুরব্বিরা যেখানে আখেরি মুনাজাত ইত্যাদি উচ্চারণ করেননি সেখানে অন্যরা কেন একে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। মুরব্বিদের দোয়া করুন বলতে শুনিনি। চিল্লায় যারা বের হবে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার পর মুনাজাতের শব্দ শুনে বোঝা যেত এখন দোয়া হচ্ছে। এতে সবাই শরিক হয়ে গেলেন। দোয়া করুন, মুনাজাতে শরিক হন, আখেরি মুনাজাত হচ্ছে ইত্যাদি কোনো ঘোষণাই নেই।
হলিউড বাংলা,মঙ্গলবার, ১৮ জানুয়ারী ২০১১
মাওলানা ফয়সল আহমদ জালালী : ঢাকা থেকে : দাওয়াত ইলাল্লাহর উত্তম একটি তরিকা হলো তাবলিগ জামাত। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এ দাওয়াতি কাজ। ব্যাপক হারে এ দাওয়াতি কাজ মুসলিম সমাজে সমাদৃত হয়েছে। এ যেন আল্লাহ তায়ালার নিোক্ত আয়াতের বাস্তব এক নমুনা। ইরশাদ হচ্ছেঃ ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে মানুষকে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা আহ্বান করো এবং তাদের সাথে আলোচনা করো উত্তম পন্থায়। (নাহলঃ ১২৫)
হিকমতের মাধ্যমে আহ্বানঃ এমন উপযোগী বাক্য চয়ন করে দাওয়াত প্রদান করো যা মানুষের মনে স্থান করে নেয়। অন্য কথায় এমন প্রজ্ঞার সাথে দাওয়াত দানকে হিকমত বলে, যার সাহায্যে দাঈ মানুষের অবস্থার তাগিদ জেনে নিয়ে তদনুযায়ী কথা বলে। সে এমন সময় ও সুযোগ খুঁজে নেয়, যা মানুষের ওপর বোঝা না হয়। নম্রতার স্থলে নম্রতা ও কঠোরতার স্থলে কঠোরতা অবলম্বন করে। স্পষ্টভাবে কথা বললে যদি মানুষ লজ্জিত হবে বলে দাঈ মনে করে তাহলে সেখানে ইঙ্গিত করে কথা বলে। ব্যস্ত থাকলে ফারিগ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, অতঃপর দাওয়াত প্রদান করে। যাতে দাওয়াতের লক্ষ্য ব্যক্তি বিরক্ত না হয় এবং তার মাঝে একগুঁয়েমির ভাব অব্যাহত না থাকে। (তাফসিরে রুহুল বায়ান) আল্লামা ইলিয়াস র. প্রবর্তিত তাবলিগ জামাতের দাওয়াতে হিকমতের এ মর্মবাণী পরিলক্ষিত হয়।
মাওইজায়ে হাসানা- সদুপদেশ দ্বারা দাওয়াতঃ মানুষের অন্তর গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয় এবং সে লক্ষ্যে মন নরমও হয়, এমন পন্থায় দাওয়াতের উপস্থাপনাকে মাওইজায়ে হাসান বলা হয়। উদাহরণ তার কাছে কবুল করার সাওয়াব ও উপকারিতা এবং কবুল না করার শাস্তি ও অপকারিতা তুলে ধরা।
তাবলিগ জামাতের দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য ও জোরালোভাবে লক্ষণীয় উত্তম পন্থায় আলোচনাঃ দাওয়াতের কাজে যদি কোথাও তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন দেখা দেয় সেখানেও তা উত্তম পন্থায় হওয়া দরকার। উত্তম পন্থার মানে হচ্ছে কথাবার্তায় নমনীয়তা অবলম্বন করতে হবে। এমন যুক্তিপ্রমাণ পেশ করতে হবে যাতে মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হয়। সুপ্রসিদ্ধ ও সুবিদিত বাক্যাবলির মাধ্যমে প্রমাণ দিতে হবে যাতে মানুষের সন্দেহ দূরীভূত হয় এবং হঠধর্মিতার পথ পরিহার করে।
এ নীতি কেবল মুসলিমদের দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে সম্পর্কযুক্ত নয়, বরং অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কেও তা প্রযোজ্য।
ফিরাউনের মতো পাষণ্ডের সাথেও নম্র আচরণের নির্দেশ ছিলঃ মুসা আঃ ও তাঁর ভাই হারুন আঃকে আল্লাহ তায়ালা ফিরাউনের প্রতি পাঠিয়ে তার প্রতি দাওয়াত দানের সময় কোমল আচরণ করতে বলেছিলেন। ইরশাদ হয়েছেঃ ‘তোমরা দু’জন ফিরাউনের কাছে যাও, সে তো সীমা লঙ্ঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে। (সূরাঃ ত্বহা, আয়াত-৪৩-৪৪)
মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করার এ তিনটি মূলনীতি অবলম্বন করেই তাবলিগ জামাতের দাওয়াত পরিচালিত হচ্ছে। এখানে কোনো বাড়াবাড়ি নেই, ছাড়াছাড়িও নেই।
তাবলিগ জামাতে কোনো একগুঁয়েমি নেইঃ যেহেতু এটি একটি খালিস দাওয়াতি কর্মপন্থা। ফলে এখানে লক্ষ করা হয় কিভাবে পথভোলা মানুষকে আল্লাহ্মুখী করা যায়। কোনো একক নীতি এখানে মুখ্য বিষয় নয়। এর ফলে বিশুদ্ধতার স্বার্থে কিংবা স্থান-কাল-পাত্রের চাহিদায় এতে সংশোধন ও সংযোজন করা হয়। তাবলিগ জামাতে যে গ্রন্থটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় তার নাম এক সময় ছিল তাবলিগি নিসাব। বর্তমানে একে ফাজায়েলে আমল বলা হয়। এক সময় শুধু এ গ্রন্থটিকেই পাঠ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বর্তমানে মুনতাখাবে হাদিস পুস্তিকা ওয়াহিদ এলাজ ইত্যাদিও পাঠ করা হয়। আরবি ভাষাভাষীদের জন্য হায়াতুস সাহাবাও পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এক সময় বলা হতো তাবলিগের ছয়টি উসুল। এর ফলে কিছু সমালোচক বলত ইসলামের মূল ভিত্তি পাঁচটি, কিন্তু তাবলিগিরা বাড়িয়ে তা ছয়টি বানিয়েছেন। মূলত এটি সমালোচনার কোনো বিষয় নয়। এটিকে ইসলামের ভিত্তি বলে কেউ কোনো দিন দাবিও করে না। বলা হয়, এ ছয়টি জিনিসের ওপর যত্নবান হলে দ্বীনের ওপর চলা সহজ। এক সময় একে উসুল বলা হতো, কিন্তু এখন একে ছয়টি সিফাত বা গুণ বলা হয়। এক সময় দায়িত্বশীলকে বলা হতো আমীর এখন বলা হচ্ছে জিম্মাদার। এমনকি এখন শূরা পদ্ধতিকে অনুসরণ করা হচ্ছে।
তাবলিগ জামাত শিরক বিদআতমুক্তঃ শিরক ও কুফরের বিরুদ্ধেই তাবলিগ জামাতের দাওয়াত। মুসলিম বলতে সবাই শিরকমুক্ত থাকতে চায়, কিন্তু অজ্ঞতা ও অসাবধানতাবশত অনেক সময় শিরকের কাজ করে বসে। দলীয় প্রধান বা মুর্শিদের প্রতি যেভাবে মাত্রাতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখানো হয় তা অনেকটা আল্লাহকে তাজিম করার মতো, যা শিরকের নামান্তর। কিন্তু তাবলিগ জামাতে আমীর ও সাধারণ একাকার। একই ধরনের খানা সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে। নেই এখানে আমীর-ফকিরের কোনো ভেদাভেদ। এ যেন রাসূলুল্লাহ সাঃ ও সাহাবায়ে কেরামের সোনালি জমানার এক জীবন্ত নমুনা। এখানে সেবক ও সেবিত বলতে কেউ নেই, সবাই খাদিম আর সবাই মাখদুম। একজন রাজকীয় হালে সাজানো খাঞ্জায় বসে মুরগির রান টানবে আর একদল খাদিম তা সরবরাহ করার জন্য তটস্থ থাকবে, এ ধরনের দৃশ্য তাবলিগ জামাতে নেই।
তাবলিগ জামাতে কোনো পরনির্ভরতা নেইঃ আল্লাহর দেয়া জান ও মাল তাবলিগ জামাতে ব্যয় করতে পরামর্শ দেয়া হয়। অপরের মালের প্রতি এতে লোভ আসে না। সাথীদের অবস্থা বিবেচনা করে দৈনিক টাকা উঠানো হয় এবং সে অনুপাতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অপরের কিছু খাওয়ার সুওয়াল নেই, সুওয়ালের কোনো ভানও করতে নেই।
দাওয়াতে তাবলিগে কোনো ব্যক্তিনির্ভরতা নেইঃ তাবলিগ জামাতের সব কাজ শূরার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এখানে ব্যক্তিপূজার কোনোই অবকাশ নেই। হজরতের মুখ দিয়ে যা বের হবে তা সবাইকে মানতে হবে, এমন কিছু নেই তাবলিগ জামাতে। মাশওয়ারার ভিত্তিতে জিম্মাদারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা আসে তা মান্য করাই কামিয়াব রয়েছে বলে শেখানো হয়। প্রকৃত অর্থে এটিই ইসলামের শিক্ষা। এতেই রয়েছে সফলতা।
পার্থিব মোহমুক্ত একটি অনুপম দাওয়াতি ধারাঃ সব ধরনের কৃত্রিমতাবর্জিত সুন্নাহ সমর্থিত একটি আদর্শ দাওয়াতি ধারা হলো তাবলিগ জামাত। এতে পার্থিব কোনো মোহ দৃশ্যমান নয়। হাদিয়া-তুহফা আদায়ের কোনো কৌশলী ব্যবস্থাও নেই এখানে। আজ ইসলামের নামে যা চলছে, খানকাহ, দরগাহ পীর-মুরিদীর নামে যে ব্যবসা চলছে; তা দেখে বিজাতীয়রাও লজ্জা পায়। অথচ তাবলিগ জামাতের লোকদের চলাফেরা, আচার-আচরণ দেখে বহু বিধর্মী ইসলামে দীক্ষিত হচ্ছে। ইসলামের সুমহান বাণী, এর কৃষ্টিকালচার দেখে বিমুগ্ধ হয়ে অনেক অমুসলিম অভিযোগ করছে, কেন আমাদের কাছে আগে এ দাওয়াত পৌঁছানো হয়নি। মুসলিম না হওয়ার ফলে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে শাস্তির সম্মুখীন হবে, এর জন্য দায়ী কারা? ছোটখাটো বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা সব ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক। কিন্তু সার্বিকভাবে তাবলিগ জামাতের কাজকর্ম ও দাওয়াত ইলাল্লাহর পদ্ধতি জমহুর উলামায়ে কিরাম নির্ভেজাল বলে মনে করেন। আল্লাহর পথে নিবেদিতপ্রাণ মুরব্বিদের পরামর্শই হলো তাবলিগ জামাতের কর্মপদ্ধতি। এসব মুরব্বির খালিস নিয়ত ও তাকওয়া প্রশ্নাতীত। এ কারণে তাবলিগ জামাতের দাওয়াতে যেভাবে মানুষ আল্লাহর পথে উঠছে; অন্য কোনো তরিকায় সেভাবে দেখা যায় না।
বিশ্ব ইজতেমা মুনাজাতসর্বস্ব না হওয়া চাইঃ বিশ্ব ইজতেমার সময় একটি শব্দ খুবই আলোচিত হয়। তা হলো আখেরি মুনাজাত। এতে অংশগ্রহণের জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ইজতেমা ময়দানের চার পাশে ভিড় করে। এ দিন চতুর্দিক থেকে কত মানুষ যে অংশগ্রহণ করে তার কোনো হিসাব নেই। পরিসংখ্যান করতে যারা নিয়োজিত তারা কেবল বড় বড় প্রবেশ পথগুলো দেখে জরিপ চালায়। কিন্তু চারপাশের অলিগলি এবং তার এক্সটেনশন যে কত দূর বিস্তৃত তা দেখবে কে?
জনস্রোত না জনসমুদ্র, কোনো শব্দ দিয়েই মনে হয় এ মহামিলনকে ব্যক্ত করা যাবে না। এ তো হলো সাধারণ মুসলিমের কথা। এর সাথে রয়েছে বড় বড় রাজনৈতিক দলের বড় নেতাদের অংশগ্রহণের বিষয়। দলবল নিয়ে তারাও সেখানে উপস্থিত হন আখেরি মুনাজাতে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, এটি ভালো কাজ। কিন্তু কেবল মুনাজাতে অংশগ্রহণই মুখ্য হওয়া উচিত নয়। মুনাজাতের আগে বিশ্বমানের মুরব্বিরা যে বয়ান দেন তা মনের কান দিয়ে শুনলে বড় ভালো হতো। সে মতো চললে দেশ ও জাতির বড়ই উপকার হতো। সে আলোকে রাষ্ট্রপরিচালনা করলে ফিরে আসত খেলাফতে রাশেদার সোনালি যুগ। এ খাতে সে খাতে দেশ হতো না দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। ধনী-দরিদ্রের পাহাড়সম বৈষম্য থাকত না মানবসমাজে। আশা করি আমাদের নেতানেত্রীরা সে দিকে নজর দেবেন। মুনাজাতে অংশগ্রহণকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন না। দেশ ও দল পরিচালনায় ইসলামের ধারে কাছেও নেই অথচ বিরাট বহর নিয়ে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করে দেখালাম আমিও ইসলামের পথে আছি। কপটতা আর কাকে বলে! রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করলে জনগণ যেভাবে উপকৃত হয় অন্য কোনোভাবেই ততটুকু হয় না। আল্লাহর কাছে করজোড়ে দোয়া করি আল্লাহ আমাদের নেতানেত্রীদের সুমতি দান করুন। বিশ্ব ইজতেমাকে আল্লাহ তায়ালা গোটা উম্মাহর হেদায়াতের জন্য অছিলা হিসেবে কবুল করুন।
মনে রাখবেন, ‘আখেরি মুনাজাত’ বলে তাবলিগের মুরব্বিদের মুখ থেকে কোনো কিছু শোনা যায়নি। লোকমুখে এবং মিডিয়ায়ই এ শব্দের প্রয়োগ বেশি।এর জন্য কোনো ঘোষণাও করা হয়নি। তা সঙ্গতও নয়। আগেই বলেছি, তাবলিগ জামাতে কোনো বিদআত-আশ্রয়ী কাজ করা হয় না। এ দোয়া মূলত করা হয় আল্লাহর রাস্তায় যেসব জামাত রওনা করে তাদের কামিয়াবির লক্ষ্যে, উম্মতের হেদায়াতের লক্ষ্যে।
আমরা যারা মুনাজাতে অংশগ্রহণের জন্য উদগ্রীব, যদি আমরা জামাত-বন্দী হয়ে যেতাম তাহলে প্রকৃত দোয়ার উপযুক্ত আমরাও হয়ে যেতাম। হেদায়াতের নূর আমাদের ওপরও চমকাত। আল্লাহ আমাদের হেদায়াত দান করুন। মুনাজাতসর্বস্ব বিশ্ব ইজতেমা কারো কাম্য নয়। হেদায়াতমূলক বিশ্ব ইজতেমা কতই না ভালো!
বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণজমায়েতে ও আখেরি মুনাজাত বলতে কিছুই নেইঃ আরাফাতের মাঠে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। একেই হজের প্রধান অনুষ্ঠান বলে। এ অনুষ্ঠানটি আমি সব সময়ই দেখে থাকি। এবারকার অনুষ্ঠানটি দেখার পর আমার মনে জাগল, এ দিনটি সর্বশ্রেষ্ঠ দিন, এটি সবচেয়ে পবিত্র স্থান। এখানকার দোয়া কবুল হয় না বলে মনে করাও গোনাহের কাজ। বয়ান শেষে ইমাম সাহেব সালাত আদায় করলেন; অতঃপর সবাই উঠে রওনা করলেন। কোনো মুনাজাতের আয়োজন নেই। ভাবলাম সবাই মিলে মুনাজাত করলে কত কান্নার রোল পড়ত। আল্লাহ তায়ালা কবুল করতেন। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা এলো রাসূলুল্লাহ সাঃ এরূপ করেননি বলেই হয়তো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
আমাদের সব কর্মকাণ্ড ওয়াজ-নসিহত সুন্নাহ মোতাবেক হওয়া চাই। তাবলিগের মুরব্বিরা যেখানে আখেরি মুনাজাত ইত্যাদি উচ্চারণ করেননি সেখানে অন্যরা কেন একে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। মুরব্বিদের দোয়া করুন বলতে শুনিনি। চিল্লায় যারা বের হবে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার পর মুনাজাতের শব্দ শুনে বোঝা যেত এখন দোয়া হচ্ছে। এতে সবাই শরিক হয়ে গেলেন। দোয়া করুন, মুনাজাতে শরিক হন, আখেরি মুনাজাত হচ্ছে ইত্যাদি কোনো ঘোষণাই নেই।
Monday, 3 September 2012
তাবলীগ জামাত নিয়ে যারা সমালোচনায় পঞ্চমুখ তাদের বলছি
ইদানিং এস বি ব্লগে অনেক ব্লগার ভাইদেরই তাবলীগ জামাত সম্পর্কে অনেক নেতীবাচক পোস্ট ও কমেন্ট করতে দেখে রীতিমত হতাশ হয়েছি।
আমরা যারা আজ দাওয়াতী কাজে নিজেকে জড়িত করে দ্বীনের দায়ী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি, অথবা দাওয়াতী কাজে সামান্য হলেও নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি, তাদের কাছে আমার স্ববিনয় আহবান হচ্ছেঃ
আসুন না! একটু দেখে নিই আমাদের অবস্থা। আমিও একজন দ্বীনের সামান্য খাদেম হিসাবে বলছিঃ
আমরা দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছি কোথায়? মসজিদে? সভা-সেমিনারে? আম জলসায়? স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায়? শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হল রূমে?
একটু ভেবে দেখুন তো, এ সমস্ত স্থানে কারা আসছে? এ সমস্ত স্থানে আসছে-
যারা নিয়মিত নামাজ পড়ছে,
দ্বীন ধর্ম নিয়ে চর্চা করছে,
নিজেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যে সপে দিতে চেষ্টা করছে,
মহান আল্লাহ তায়ালার আযাব ও গজবের ভয় যাদের মধ্যে রয়েছে, তারাই। তাই নয় কি?
পক্ষান্তরে যারা মসজিদে আসছে না, কোন সভা সেমিনারেও যাচ্ছে না, স্কুল-কলেজ বা মাদ্রাসায়ও যাচ্ছে না, তাদেরকে দ্বীন কে বোঝাবে? তাদেরকে কলিমা ও এর অর্থ কে বোঝাবে? সুরা ফাতেহা, সূরা ইখলাস কে শিখাবে? হালাল-হারাম সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান কে দিবে?
কারণ, আমরা তো তাদের নিকট যাচ্ছিনা।
অত্যন্ত আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছেঃ আমরা হয়ত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছি, ইয়ারকণ্ডিশন গাড়ীতে চড়ে সভা-সেমিনারে যাচ্ছি, সাধারণ মুসলমানদের সেবা-যত্ন পেয়ে আমরা ধন্য হচ্ছি। বিনা বেতনে এক ওয়াক্ত ইমামতীও করতে আমাদের গায়ে লাগে। দাওয়াতী প্রোগ্রাম তো দুরের কথা।
মোটা অংকের পয়সা নিয়ে আমরা আজ দ্বীনের দায়ী হয়েছি। এক মাসের বেতন না পেলেই আমাদের ঈমানী জযবার ১০০% বহিঃপ্রকাশ ঘটবে নিশ্চিত।
তাহলে যারা খেটে খাওয়া মুসলমান, যারা দিন-মজুর, যারা জীবনে কোন দিন স্কুল-মাদ্রাসার বারান্দায়ও যায়নি, অথচ বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে, কুশিক্ষা-অশিক্ষায় যারা জর্জরিত, মুসলমান অথচ কলিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বাক্যটি ঠিকমত উচ্চারণও করতে শিখেনি, তাদেরকে মসজিদ পর্যন্ত কে নিয়ে আসবে? কোন মাদ্রাসায় তাদের ভর্তি করানো যাবে? তাদের মুখে কলিমার উচ্চারণটুকু মৃত্যুর পূর্বে কে উচ্চারিত করাবে?
কেননা, আপনি আমি তো শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেই দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে শিখেছি। উম্মতের এই করুণ ও নির্মম অবস্থায় যারা নিজের সময়, শ্রম, তথা টাকা-পয়সা খরচ করে পথ ভোলা মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দিচ্ছে, মসজিদ ভোলা মুসলমানদের মসজিদ পানে নিয়ে আসছে, কলিমা ও নামাজের সাথে শতভাগ অপরিচিত, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ, যাদের কোন শিক্ষালয়েই এডমিশন হবে না, তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে যারা দ্বীনের প্রাথমিক কথাগুলি শিক্ষা দিচ্ছে, সমাজের অবহেলিত ঐ মুসলমানদের হাতে-পায়ে ধরে যারা আল্লাহর ঘর মসজিদে প্রবেশ করাচ্ছে, সেই তাবলীগ জামাত নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও নেতীবাচক পোস্ট দেখে অবাক হওয়া ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না?
যারা তাবলীগ জামাতের সমালোচনায় পঞ্চমুখ, তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা! আজ পর্যন্ত কতজন আল্লাহ ভূলা মুসলমানকে মসজিদে নিয়ে আসতে পেরেছেন? এমন কতজন মুসলমানকে কলিমা শিখিয়েছেন, যারা কলিমা না জেনেই বয়সের ভারে পিঠ বাঁকা হয়ে গিয়েছে? এমন কতজন মুসলমানকে সূরা ফাতেহা শিখিয়েছেন, যাদের দাড়ী সাদা হয়ে গিয়েছে? এমন কতজন মুসলমানকে পবিত্রতা অর্জনের শিক্ষা দিয়েছেন, যারা পবিত্রতা আর অপবিত্রতার ফারাকই বোঝে না? এমন কতজনকে হালাল-হারামের শিক্ষা দিয়েছেন? বান্দার হক্ব আর আল্লাহর হক্বের পরিচয় শিখিয়েছেন?
অবশেষে বলতে চাই, প্রথমে কমপক্ষে নিঃস্বার্থ ভাবে, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে নিজের সময়, শ্রম ও অর্থকড়ি খরচ করে দ্বীনের দাওয়াতী কাজ করে দেখান! অবহেলিত-উপেক্ষিত, কুশিক্ষা আর অশিক্ষায় জর্জরিত মুসলমানদের দ্বারে দ্বারে-ঘুরে ঘুরে, হাতে-পায়ে ধরে মসজিদে নামাজের কাতারে এনে দাড় করান। আলহামদু সূরাটি শিখান! এবং ঘোষণা করুন! ইন আজরিয়া ইল্লা আলাল্লাহ- কারো নিকট কোন প্রত্যাশা নয় বরং একমাত্র আল্লাহর কাছেই সকল প্রত্যাশা। অতঃপর তাবলীগ জামাতকে বলুন! আপনাদের মধ্যে অনেক ভূল রয়েছে, শুধরিয়ে নিন।
যারা তাবলীগ জামাত এর কার্যক্রম শুরু করেছেন, তারা নিজের খেয়ে-পরেই কাজ করেছেন, নিজের জীবনটাকেই শপে দিয়েছেন উম্মতের আল্লাহ ভূলা মানুষগুলোকে আল্লাহর পথে আনার জন্যে। অতএব আসুন! আমরাও এমনভাবে কাজ করতে সচেষ্ট হই!
যেভাবে আমি সত্যকে পেলাম-৬
রেডিও তেহরান,শনিবার, ৩০ জুন ২০১২
জাপানি রমনী নাকাতা খাওলার ইসলাম গ্রহণ
ফ্রান্সে সেক্যুলার শাসন ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী সেখানে বিশ্বাসের স্বাধীনতা রয়েছে। পারিভাষিক অর্থে সেখানকার সরকার কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তিগত ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকা তাদের সরকার ব্যবস্থার মৌলিক একটি ভিত্তি বলে মনে করা হয়। অতএব তাদের নিজেদের দেশের মেয়েদের ওপর হিজাব ব্যবহারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা মোটেই সমীচীন নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ যদিও বলেছে যে ফ্রান্সে সর্বপ্রকার ধর্মীয় পোশাক ব্যবহারের ওপরই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তারপরও এই আইন আসলে ইসলামী হিজাবকেই টার্গেট করে করা হয়েছে। ফ্রান্সের অভ্যন্তরে হিজাবের বিস্তারে পশ্চিমারা যে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এই পদক্ষেপ তারই প্রমাণ বহন করে। কেননা ফ্রান্সের পরপরই ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ইসলামী হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এত কিছুর পরও পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর পর্যালোচনা এবং সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে প্রমাণিত হয়েছে, ইসলামকে কোনঠাসা করার লক্ষ্যে জার্মানি এবং ফ্রান্সের মতো অন্যান্য পশ্চিমা দেশে ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও সেসব দেশে ইসলাম যে কোনঠাসা হয় নি তা-ই নয় বরং সেসব দেশে হিজাবের প্রতি অনুরাগ তথা ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা লক্ষ্য করেছে সবাই।প্যারিসে বসবাসরত নাকাতা খাওলা নামের জাপানি এক রমনী ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলমান হবার পর তিনি যখন হিজাব পরলেন তখন তিনি তাঁর অস্তিত্বে নতুন এক মূল্যবোধ ও পরিচিতি অনুভব করতে লাগলেন। হিজাবকে তিনি তাঁর উন্নয়ন ও বিকাশ এবং সমাজে নারীদের আরো বেশি উপস্থিতির সহায়ক বলে উল্লেখ করেন। তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের পেছনে কী কী কারণ ছিল সে সম্পর্কে বলেছেনঃ
ইসলাম গ্রহণ করার আগে ফ্রান্সের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিজাবধারী মেয়েদের ব্যাপারে বিশেষ ধরনের আলাপ আলোচনা হতো,অবশ্য এখনো হচ্ছে।বেশিরভাগই মনে করতো ফ্রান্সের সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ছাত্রীদের ধর্মীয় ব্যাপারে নাক গলানো উচিত।আমি নিজেও অমুসলিম থাকাকালে ভাবতাম স্কুল কর্তৃপক্ষ কেন ছাত্রীদের স্কার্ফ পরার মতো ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি করছে।অমুসলিমরা সবসময় ভাবতো মুসলিম নারীরা ইসলামের রীতিনীতি বা ঐতিহ্যগুলোর অনুসরণ করতে বাধ্য হবার কারণেই ইসলাম পোশাক পরে।এ কারণে অমুসলিমরা ভাবতো মুসলিম নারীর হিজাব নারীদের ওপর এক ধরনের জুলুম বা অত্যাচারের শামিল, তাই হিজাব তুলে নেওয়ার মধ্যেই নারীদের স্বাধীনতা ও মুক্তি নিহিত রয়েছে বলে তারা বিবেচনা করতো। বিশ্বব্যাপী এখন অমুসলিম নারীগণ ইসলাম গ্রহণের পর উপলব্ধি করছেন যে হিজাব কতোটা যুক্তিসঙ্গত একটি ধর্মীয় প্রথা! আমি নিজেও তাদেরই একজন। আমার হিজাব আমার বর্ণগত কিংবা প্রথাগত কোনো পরিচয়ের অংশ নয় কিংবা এর কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক অর্থও নেই,আমার হিজাব একান্তই আমার ধর্মীয় পরিচয়।
আমি যখন ইসলাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেই, তখন একদম ভাবি নি, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে পারবো কিনা, কিংবা নিজের হিজাব সংরক্ষণ করতে পারবো কিনা? মুসলমান হবার আগ্রহ এতো বেশি ছিল যে মুসলমান হবার পর যেসব পরিবর্তন আমার জীবনাচারে আসবে সেসব ব্যাপারে একেবারেই উদ্বেগহীন ছিলাম। ইসলাম গ্রহণ এবং হিজাব পরার ব্যাপারে মিস নাকাতা বলেনঃ প্যারিসের মসজিদে একটি বক্তৃতা শোনার পর হিজাব পরার গুরুত্বটা উপলব্ধি করলাম। মসজিদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে যে স্কার্ফটি মাথায় পরেছিলাম, মসজিদ থেকে বের হবার পরও স্কার্ফটা আর খুললাম না। ঐ বক্তৃতা আমাকে এমনভাবে আত্মিক প্রশান্তি দিয়েছিল যে ইতোপূর্বে কখনোই এমন ধরনের অনুভূতির সাথে পরিচিতই ছিলাম না। তাই স্কার্ফ ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতে একদম মন চাচ্ছিল না। শীতের কারণে সে সময় আমার স্কার্ফের প্রতি কারো নজর পড়ে নি, তবে আমি নিজে ভীষণভাবে অনুভব করলাম যে অন্যদের সাথে আমার একটা পার্থক্য রয়েছে। সেইসাথে এক ধরনের পবিত্রতা এবং নিরাপত্তাও বোধ করলাম।
মুসলমান হবার আগে নাকাতাও হিজাবকে সীমাবদ্ধতা বলে মনে করতেন, কিন্তু এখন তিনি নিজেই হিজাব পরেন এবং এ ধরনের পোশাককে খুবই মূল্যবান এবং ইমানের পরিচয় বলে মনে করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেনঃ হিজাব পরে খুব প্রফুল্ল বোধ করতাম। হিজাব আল্লাহর আদেশের অনুসরণ এবং ইমানের দ্যুতির পরিচায়ক হিসেবে আমার কাছে সমাদৃত হয়েছিল। হিজাব করার ফলে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে সরবে উচ্চারণ করার প্রয়োজন পড়তো না, হিজাব দেখে সবাই আমার ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবেই বুঝতে পারতো। হিজাব লোকজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়-আল্লাহর অস্তিত্ব রয়েছে,আর আমাকেও স্মরণ করিয়ে দেয় সবসময় একজন মুসলমানের মতো আচরণ করতে হবে। একজন পুলিশ অফিসার তার পেশাগত ইউনিফর্ম পরে যেভাবে সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করে,আমিও হিজাব পরে আমার মুসলমানিত্বের বিষয়টি অনেক বেশি উপলব্ধি করি।
মিস নাকাতা তাঁর বর্তমান জীবনকে অত্যন্ত সুন্দর বলে মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন হিজাবধারী নারী ব্যক্তিত্ব,মর্যাদা,প্রশান্তি এবং আত্মবিশ্বাসে সমৃদ্ধ। ইসলামে হিজাবের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি বলেনঃ হিজাবকে অগভীর দৃষ্টিতে দেখলে কিংবা বাহ্যিক দিক থেকে দেখলে তার প্রকৃত সত্য ও বাস্তবতা সম্পর্কে জানা কঠিন হবে। যারা অসচেতনভাবে বাইরে থেকে ইসলামের দিকে তাকায় তারা হিজাবকে মনে করতে পারে সীমাবদ্ধতা আরোপের নিদর্শন হিসেবে। কিন্তু ইসলামের ভেতরে আসলে শান্তি, মুক্তি এবং আনন্দ ও স্বাদ ছাড়া আর কিছু নেই। এ আনন্দ এমন এক আনন্দ যা ইতোপূর্বে সে পায় নি। ইসলামের অনুসারীরা এই আদর্শকে সেক্যুলারিজমের তথাকথিত মুক্তির পরিবর্তে গ্রহণ করেছে। এখন প্রশ্ন জাগে ইসলাম যদি নারীদের ওপর জুলুমই করবে, তাহলে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষিত ও তরুণীরা কেন এই ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে। হিজাবধারী একজন নারী ফেরেশতার মতো সুন্দর। কিন্তু গোঁড়ামির অন্ধত্বের কারণে অন্যরা ঐ সৌন্দর্য দেখতে পায় না।
মিস নাকাতা ইসলামী হিজাবকে নারীর সৌন্দির্য বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেন এবং এটা ইসলামের মৌলিক একটি শিক্ষা।ইসলাম সমাজের আত্মিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সমাজে বা কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে নিরাপদ ও বৈধ সম্পর্ক সৃষ্টির জন্যে বাহ্যিক ঐ পোশাক পরে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৎপরতা চালানোর শিক্ষা দিয়েছে,যাতে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়া যায়।
যেভাবে আমি সত্যকে পেলাম-৫
রেডিও তেহরান, সোমবার, ১৬ জুলাই ২০১২
মার্কিন রমনী মেরিলিন হিলের ইসলাম গ্রহণ
ইসলামের অর্জনের মধ্যে রয়েছে সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিস্তার,মূর্খতা ও জুলুম অত্যাচার থেকে মানুষের মুক্তি, ইসলামী দুনিয়ায় জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বিকাশ এবং অপরাপর জাতির কাছে সেই জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো ইত্যাদি।মানব সমাজের ওপর তাই ইসলামের ব্যাপক প্রভাবের ঐতিহাসিক প্রমাণপঞ্জি অনস্বীকার্য।মুসলিম এবং অমুসলিম এমনকি ইউরোপীয় মনীষীগণও এই সত্য স্বীকার করেছেন যে, ইসলামের নবী তাঁর মূল্যবান শিক্ষাগুলোর সাহায্যে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত লেখক জর্জ বার্নার্ড শ নবী করিম (সা) সম্পর্কে বলেছেনঃ
"তাঁকে মানবতার ত্রাণকর্তা বলে সম্বোধন করা উচিত।আমার বিশ্বাস যদি তাঁর মতো একজন ব্যক্তি নবযুগের শাসক হতেন তাহলে তিনি সমস্যা নিরসনে শান্তি ও বন্ধুত্বের আশ্রয় নিতেন।পৃথিবীর বুকে তিনিই ছিলেন সর্বশেষ্ঠ মানব।তিনি দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন,একটি সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছেন,একটি জাতির ভিত্তি রচনা করেছেন,নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করেছেন, শক্তিশালী ও জীবন্ত একটি সমাজ সৃষ্টি করেছেন।এরকম একটি সমাজ তাঁর শিক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করার জন্যে প্রয়োজন ছিল,যেসব শিক্ষা মানবিক আচরণ ও চিন্তাজগতে সবসময়ের জন্যে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিল। তাঁর নাম 'মুহাম্মাদ'। মুহাম্মাদ তাঁর মাত্র তেইশ বছরের নবুয়্যতিকালে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদাত করার দিকে পরিচালিত করেন।
তিনি জনগণকে গোত্রীয় দ্বন্দ্ব কলহ থেকে মুক্তি দেন এবং তাদের মাঝে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করেন।এই সময়ের মধ্যে তিনি মানুষকে যাবতীয় অশ্লীলতা ও নেশা থেকে মুক্তি দিয়ে ভারসাম্য ও মিতাচারে অভ্যস্ত করে তোলেন। সেইসাথে বেআইনী জীবনযাপন থেকে সুশৃঙ্ক্ষল জীবনযাপনের শিক্ষা দেন, ধ্বংস ও বিনাশ থেকে উন্নত নৈতিকতা ও চারিত্রিক মানদণ্ডের দিকে পরিচালিত করেন। মানবেতিহাসে ইসলামের নবীর আগে কিংবা পরে এরকম আমূল পরিবর্তন-তাও মাত্র একজন ব্যক্তির পক্ষ থেকে-অন্য কোথাও আর ঘটে নি। শতাব্দির পর শতাব্দি পেরিয়ে যাবার পরও ইতিহাস রচনায় নবীজীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মানুষের ইসলাম গ্রহণের অন্যতম একটি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। মার্কিন নওমুসলিম মেরিলিন হিল তাঁর নাম পাল্টে রেখেছেন মারিয়াম। তিনি সম্প্রতি ইসলামের সত্যাসত্য উপলব্ধি করেন এবং ইবাদাত বন্দেগির মিষ্টি স্বাদ আস্বাদন করেছেন। মেরিলিন জন্মেছেন এবং বেড়ে উঠেছেন এক খ্রিষ্টান পরিবারে। তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার নেপথ্য প্রেরণা সম্পর্কে বলেছেনঃ সবসময়ই গির্যার ওপর কর্তৃত্বপরায়নদের পরম্পরা আর অভ্যন্তরীণ বিষয় আশয়ের সাথে আমার সমস্যা ছিল।একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম গির্যায় আর যাবো না। আমি ভাবতাম লোকজন সপ্তায় কেবল একদিন গির্যায় যায়,এরপর আর দ্বীনী কোনো কাজ করে না-এটা এক ধরনের কপটতা। সেজন্যে সিদ্ধান্ত নিলাম আধ্যাত্মিকতাকে আমার জীবনে সংরক্ষণ করবো,তবে দ্বীনের আদলে নয়। তখনো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল,বিশ্বাস অবশ্য সবসময়ই আমার অস্তিত্ব জুড়ে ছিল। তবে আল্লাহর আনুগত্য করার পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই পুরোটা সময় সত্যের সন্ধানে ছিলাম। এরিমাঝে এক মুসলিম নারী আমার জীবনে আসে এবং আধ্যাত্মিকতার আলোকপূর্ণ এক পৃথিবী তার সাথে নিয়ে আসে আমার জন্যে।
মেরিলিন আরো বলেনঃ একদিন সে আমার এবং আমার মায়ের বিজ্ঞাপন দপ্তরে আসে কোরআনের কিছু আয়াত একটি সাইটে দেয়ার অনুরোধ করতে। বহু ইসলামী সাইটেই কোরআনের আয়াত আছে তবে তার পরিকল্পনাটা ছিল ভিন্নরকম। সে চেয়েছিলো প্রত্যেকটি লাইনের নিচে একটা স্পেস রাখতে যাতে পাঠক কোরআনের ঐ অংশ সম্পর্কে তারঁ অভিমত লিখে রাখতে পারেন। সে প্রতিদিন আসতো একসাথে সাইটের কাজ করার জন্যে। এই সাইটের ডিজাইন করতে গিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম ইসলাম কতোটা সুন্দর, কতোটা প্রেম ভালোবাসা আর বন্ধুত্বপূর্ণ। ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি মুসলমান হবো। আল্লাহর কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই এজন্যে যে তিনি এই নারীকে আমার জীবনে নিয়ে এসেছিলেন,যার ফলে আমি ইসলামের সত্য সঠিক পথের সন্ধান পেলাম।"
মারিয়ামের মাঝে এখন নবীজী সম্পর্কে এবং তাঁর আচরণ পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন এক অনুভূতি জেগেছে। ইসলামের নবীর প্রতি তার অনুরাগ সম্পর্কে মারিয়াম বলেনঃ যখন শাহাদাতাইন-কালেমা-বলতাম,প্রতিটি শব্দ ভালোভাবে খেয়াল করতাম এবং সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করতাম যে,আল্লাহ ছাড়া আর কোনো খোদা নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) তাঁর প্রেরিত রাসূল। কিন্তু কালেমার স্বাক্ষী দেওয়ার পর যে বিষয়টি আমার জন্যে কঠোর হয়ে দেখা দিলো তাহলো আমি বুঝতে পারছিলাম না যে মুহাম্মাদ (সা) কে কেন ভালবাসতে হবে। আমি অন্য নবীকে ভালবাসতাম কিন্তু মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতাম না। দুঃখজনকভাবে যেটুকু জানতাম তা ছিল তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক চিত্র যা ছিল পশ্চিমা সমাজে প্রচারিত তাঁর বিকৃত স্বরূপ। নবীজীর জীবনপঞ্জী পড়তে পারতাম কিন্তু এদের কেউই আমার অন্তরে তাঁর সম্পর্কে কোনোরকম অনুরক্তি জাগ্রত করে নি।
অবশেষে ইসলামের ইতিহাস এবং নবীজীর জীবনী সংক্রান্ত একটি বই আমার হাতে আসে। এ বইতে ইসলাম-পূর্ব আরবের ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এবং নবীজীকে উন্নত নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঐ বইটি কোনো মুসলমানের লেখা ছিল না, বইটি লিখেছেন একজন খ্রিষ্টান পাদ্রি। বইটি পড়ার পর আমার সামনে আলোকিত পৃথিবীর আরেকটি জানালা খুলে গেল এবং নবীজীর প্রতি আমার অনুরাগ এতো গভীর পর্যায়ে গেল যে তারপর থেকে ক্রমশ সেই ভালোবাসা বেড়েই যেতে লাগলো।" এই নবীজী সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছেঃ "যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম চরিত্রের নমুনা।"
কোরআনের বহু জায়গায় রাসূলে খোদার সর্বোত্তম চারিত্রিক ও নৈতিকতার বর্ণনা রয়েছে,বতর্মান বিশ্ব যার অভাব বোধ করছে তীব্রভাবে। বিশিষ্ট রুশ লেখক লিও টলস্টয় নবীজীকে সকল দিক থেকেই মর্যাদাময় এবং সম্মানীয় বলে মন্তব্য করেছেন। বিচার-বুদ্ধি এবং কৌশল সমৃদ্ধ বিধি বিধানের কারণে তাঁর দেওয়া ইসলামী শরিয়ত ভবিষ্যৎ বিশ্বকে জয় করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মার্কিন রমনী মেরিলিন হিলের ইসলাম গ্রহণ
ইসলামের অর্জনের মধ্যে রয়েছে সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিস্তার,মূর্খতা ও জুলুম অত্যাচার থেকে মানুষের মুক্তি, ইসলামী দুনিয়ায় জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বিকাশ এবং অপরাপর জাতির কাছে সেই জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো ইত্যাদি।মানব সমাজের ওপর তাই ইসলামের ব্যাপক প্রভাবের ঐতিহাসিক প্রমাণপঞ্জি অনস্বীকার্য।মুসলিম এবং অমুসলিম এমনকি ইউরোপীয় মনীষীগণও এই সত্য স্বীকার করেছেন যে, ইসলামের নবী তাঁর মূল্যবান শিক্ষাগুলোর সাহায্যে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত লেখক জর্জ বার্নার্ড শ নবী করিম (সা) সম্পর্কে বলেছেনঃ
"তাঁকে মানবতার ত্রাণকর্তা বলে সম্বোধন করা উচিত।আমার বিশ্বাস যদি তাঁর মতো একজন ব্যক্তি নবযুগের শাসক হতেন তাহলে তিনি সমস্যা নিরসনে শান্তি ও বন্ধুত্বের আশ্রয় নিতেন।পৃথিবীর বুকে তিনিই ছিলেন সর্বশেষ্ঠ মানব।তিনি দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন,একটি সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছেন,একটি জাতির ভিত্তি রচনা করেছেন,নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করেছেন, শক্তিশালী ও জীবন্ত একটি সমাজ সৃষ্টি করেছেন।এরকম একটি সমাজ তাঁর শিক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করার জন্যে প্রয়োজন ছিল,যেসব শিক্ষা মানবিক আচরণ ও চিন্তাজগতে সবসময়ের জন্যে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিল। তাঁর নাম 'মুহাম্মাদ'। মুহাম্মাদ তাঁর মাত্র তেইশ বছরের নবুয়্যতিকালে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদাত করার দিকে পরিচালিত করেন।
তিনি জনগণকে গোত্রীয় দ্বন্দ্ব কলহ থেকে মুক্তি দেন এবং তাদের মাঝে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করেন।এই সময়ের মধ্যে তিনি মানুষকে যাবতীয় অশ্লীলতা ও নেশা থেকে মুক্তি দিয়ে ভারসাম্য ও মিতাচারে অভ্যস্ত করে তোলেন। সেইসাথে বেআইনী জীবনযাপন থেকে সুশৃঙ্ক্ষল জীবনযাপনের শিক্ষা দেন, ধ্বংস ও বিনাশ থেকে উন্নত নৈতিকতা ও চারিত্রিক মানদণ্ডের দিকে পরিচালিত করেন। মানবেতিহাসে ইসলামের নবীর আগে কিংবা পরে এরকম আমূল পরিবর্তন-তাও মাত্র একজন ব্যক্তির পক্ষ থেকে-অন্য কোথাও আর ঘটে নি। শতাব্দির পর শতাব্দি পেরিয়ে যাবার পরও ইতিহাস রচনায় নবীজীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মানুষের ইসলাম গ্রহণের অন্যতম একটি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। মার্কিন নওমুসলিম মেরিলিন হিল তাঁর নাম পাল্টে রেখেছেন মারিয়াম। তিনি সম্প্রতি ইসলামের সত্যাসত্য উপলব্ধি করেন এবং ইবাদাত বন্দেগির মিষ্টি স্বাদ আস্বাদন করেছেন। মেরিলিন জন্মেছেন এবং বেড়ে উঠেছেন এক খ্রিষ্টান পরিবারে। তাঁর ইসলাম গ্রহণ করার নেপথ্য প্রেরণা সম্পর্কে বলেছেনঃ সবসময়ই গির্যার ওপর কর্তৃত্বপরায়নদের পরম্পরা আর অভ্যন্তরীণ বিষয় আশয়ের সাথে আমার সমস্যা ছিল।একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম গির্যায় আর যাবো না। আমি ভাবতাম লোকজন সপ্তায় কেবল একদিন গির্যায় যায়,এরপর আর দ্বীনী কোনো কাজ করে না-এটা এক ধরনের কপটতা। সেজন্যে সিদ্ধান্ত নিলাম আধ্যাত্মিকতাকে আমার জীবনে সংরক্ষণ করবো,তবে দ্বীনের আদলে নয়। তখনো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল,বিশ্বাস অবশ্য সবসময়ই আমার অস্তিত্ব জুড়ে ছিল। তবে আল্লাহর আনুগত্য করার পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই পুরোটা সময় সত্যের সন্ধানে ছিলাম। এরিমাঝে এক মুসলিম নারী আমার জীবনে আসে এবং আধ্যাত্মিকতার আলোকপূর্ণ এক পৃথিবী তার সাথে নিয়ে আসে আমার জন্যে।
মেরিলিন আরো বলেনঃ একদিন সে আমার এবং আমার মায়ের বিজ্ঞাপন দপ্তরে আসে কোরআনের কিছু আয়াত একটি সাইটে দেয়ার অনুরোধ করতে। বহু ইসলামী সাইটেই কোরআনের আয়াত আছে তবে তার পরিকল্পনাটা ছিল ভিন্নরকম। সে চেয়েছিলো প্রত্যেকটি লাইনের নিচে একটা স্পেস রাখতে যাতে পাঠক কোরআনের ঐ অংশ সম্পর্কে তারঁ অভিমত লিখে রাখতে পারেন। সে প্রতিদিন আসতো একসাথে সাইটের কাজ করার জন্যে। এই সাইটের ডিজাইন করতে গিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম ইসলাম কতোটা সুন্দর, কতোটা প্রেম ভালোবাসা আর বন্ধুত্বপূর্ণ। ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি মুসলমান হবো। আল্লাহর কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই এজন্যে যে তিনি এই নারীকে আমার জীবনে নিয়ে এসেছিলেন,যার ফলে আমি ইসলামের সত্য সঠিক পথের সন্ধান পেলাম।"
মারিয়ামের মাঝে এখন নবীজী সম্পর্কে এবং তাঁর আচরণ পদ্ধতি সম্পর্কে নতুন এক অনুভূতি জেগেছে। ইসলামের নবীর প্রতি তার অনুরাগ সম্পর্কে মারিয়াম বলেনঃ যখন শাহাদাতাইন-কালেমা-বলতাম,প্রতিটি শব্দ ভালোভাবে খেয়াল করতাম এবং সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করতাম যে,আল্লাহ ছাড়া আর কোনো খোদা নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) তাঁর প্রেরিত রাসূল। কিন্তু কালেমার স্বাক্ষী দেওয়ার পর যে বিষয়টি আমার জন্যে কঠোর হয়ে দেখা দিলো তাহলো আমি বুঝতে পারছিলাম না যে মুহাম্মাদ (সা) কে কেন ভালবাসতে হবে। আমি অন্য নবীকে ভালবাসতাম কিন্তু মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতাম না। দুঃখজনকভাবে যেটুকু জানতাম তা ছিল তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক চিত্র যা ছিল পশ্চিমা সমাজে প্রচারিত তাঁর বিকৃত স্বরূপ। নবীজীর জীবনপঞ্জী পড়তে পারতাম কিন্তু এদের কেউই আমার অন্তরে তাঁর সম্পর্কে কোনোরকম অনুরক্তি জাগ্রত করে নি।
অবশেষে ইসলামের ইতিহাস এবং নবীজীর জীবনী সংক্রান্ত একটি বই আমার হাতে আসে। এ বইতে ইসলাম-পূর্ব আরবের ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এবং নবীজীকে উন্নত নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঐ বইটি কোনো মুসলমানের লেখা ছিল না, বইটি লিখেছেন একজন খ্রিষ্টান পাদ্রি। বইটি পড়ার পর আমার সামনে আলোকিত পৃথিবীর আরেকটি জানালা খুলে গেল এবং নবীজীর প্রতি আমার অনুরাগ এতো গভীর পর্যায়ে গেল যে তারপর থেকে ক্রমশ সেই ভালোবাসা বেড়েই যেতে লাগলো।" এই নবীজী সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছেঃ "যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম চরিত্রের নমুনা।"
কোরআনের বহু জায়গায় রাসূলে খোদার সর্বোত্তম চারিত্রিক ও নৈতিকতার বর্ণনা রয়েছে,বতর্মান বিশ্ব যার অভাব বোধ করছে তীব্রভাবে। বিশিষ্ট রুশ লেখক লিও টলস্টয় নবীজীকে সকল দিক থেকেই মর্যাদাময় এবং সম্মানীয় বলে মন্তব্য করেছেন। বিচার-বুদ্ধি এবং কৌশল সমৃদ্ধ বিধি বিধানের কারণে তাঁর দেওয়া ইসলামী শরিয়ত ভবিষ্যৎ বিশ্বকে জয় করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
যেভাবে আমি সত্যকে পেলাম-৪
রেডিও তেহরান,মঙ্গলবার, ০৭ আগস্ট ২০১২
মার্কিন রমনী লিন্ডসি কোনিগের ইসলাম গ্রহণ
মার্কিন নওমুসলিম লিন্ডসি কোনিগের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করবো আজকের আলোচনা। তিনি বলেছেনঃ "ইসলামের প্রতি ইমান আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর মুহূর্তটি ছিল আমার প্রতি আমার বাবার কৌতূহল।ধর্মের প্রতি তাঁর কোনো বিশ্বাস ছিল না।কিন্তু আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর আমার মাঝে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখে তিনি ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নিঃসন্দেহে এটা ছিল আল্লাহরই কাজ। কেননা আমার বাবার প্রতি এই যে অনুগ্রহ এটা অন্য কোনো কিছু কিংবা অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না।
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম ভীতি ছড়ানোর প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এর কারণ হলো টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোরকম তদন্ত বা পর্যালোচনা করা ছাড়াই মুসলমানদেরকে দায়ী করে। এভাবে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে প্রচারণা চালায় এমনকি সামরিক হামলা করতেও দ্বিধা করে নি। একটা অবাস্তব বিষয়কে তারা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে এতো বেশি প্রচারণা চালায় যে স্বয়ং পশ্চিমাদের মাঝেই ইসলাম বিষয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। এই কৌতূহল থেকে পাশ্চাত্যে ইসলাম এবং কোরআন সম্পর্কে জানার বা স্টাডি করার একটা জোয়ার আসে। ইউরোপ এবং আমেরিকার অধিকাংশ বই বিক্রেতাদের মাঝে কোরআন এবং ইসলামী সাহিত্য বিষয়ক বই বিক্রির হিড়িক লেগে যায়। ইসলাম বিষয়ক বই পুস্তক বিক্রি করে তারা ব্যাপক লাভবান হয়।
১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পরপরই মার্কিনীদের অসম্ভবরকম ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণার কারণেই পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে ইন্টারনেটে ইসলাম বিষয়ক তথ্য খোঁজার ধুম লেগে যায়। ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা পাঠকগণ পড়ালেখা করার পর ইসলামের ব্যাপারে বিদ্বেষী না হয়ে বরং তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে দেয়। ইসলাম সম্পর্কে গভীর উপলব্ধির কারণেই তাঁরা মানবিকতার সুষমামণ্ডিত এই ধর্মের ওপর ইমান আনে। এ ধরনের গভীর উপলব্ধি থেকে পশ্চিমা মুলুকে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাঁদেরই একজন হলেন লিন্ডসি ইয়াসমিন কোনিগ। ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে এই নও মুসলিম মহিলার নিজস্ব ভাষ্য হলোঃ
"আমার নাম হলো লিন্ডসি ইয়াসমিন কোনিগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ম্যাইন অঙ্গরাজ্যে আমি বাস করি। আমি ২০০১ সালের আঠারোই সেপ্টেম্বরে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হই। আমার মুসলমান হবার গল্প এরকমঃ
"ইহুদিদের ধর্ম আমাদের খ্রিষ্টান ধর্মের চেয়ে আলাদা। খ্রিষ্টধর্ম এবং ইহুদি ধর্ম দুটো মৌলিক ধর্ম..." এই দুটি বাক্য আমরা আমাদের ক্লাসের এক শিক্ষকের কাছে শুনেছি। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। আমি সরকারী স্কুলগুলোতে পড়ার সময় ইসলাম বিষয়ে এমনকি একটি শব্দও কখনো শুনি নি। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পরই টিভি পর্দায় সারাক্ষণ চোখ রাখতাম এবং তখনই ইসলাম ও মুসলমান শব্দগুলো কানে প্রবেশ করতে থাকে। তখনই খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলাম মুসলমানদের সম্পর্কে। ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে গবেষণার ইচ্ছে জাগলো। ঠিক করলাম পুরোটা দিন এ নিয়ে স্টাডি করবো। তাই করলাম।
ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনে গিয়ে টাইপ করলাম 'মুসলিম'। সার্চ দিলাম। অমনি চোখের সামনে ভেসে উঠলো লাল,সাদা এবং নীল রঙের বিচিত্র লিংক। ইসলাম এবং মুসলমান শব্দগুলো সংবলিত সাইটের বিচিত্র অ্যাড্রেস বেরিয়ে এলো।প্রথম সাইটটিকে ঢুকলাম। ইসলাম সম্পর্কে এই সাইট থেকে বেশ কিছু জানলাম। এটুকুতেই বুঝতে পারলাম,পশ্চিমারা ইসলাম সম্পর্কে যেসব প্রচারণা চালায় সেসব প্রচারণার সাথে এর পার্থক্য প্রচুর।তাই আরো বেশি বেশি জানতে চাইলাম। ইতোমধ্যে মারিয়াম নামের মুসলিম একটি মেয়ের সাথে পরিচিত হলাম। এখানেই আমার ইসলাম গ্রহণের গল্পের প্রকৃত সূচনা হয়। মারিয়ামের সাথে সম্পর্ক গভীর হলো।ফলে তার কাছ থেকে সহযোগিতা পাবার সুযোগ হলো।
বিশেষ করে মার্কিন টিভি চ্যানেলগুলো দেখে দেখে বুঝতে পারলাম প্রচারণাগুলো পক্ষপাতদুষ্ট,তাই মনে আরো বেশি প্রশ্ন জাগতে লাগলো। মারিয়াম অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে লাগলো। সেইসাথে ইসলামের বিধিবিধান এবং শিক্ষাগুলো দিতে লাগলো। এইসব হুকুম আহকাম অবশ্য আমার কাছে খুব বেশি আকর্ষণীয় ছিল না। তবে দার্শনিক প্রজ্ঞা, আল্লাহর দয়াশীলতা, সুশৃঙ্ক্ষল কাঠামো সবোর্পরি ইসলামের আধ্যাত্মিকতা আমাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছিল।
লিন্ডসি কোনিগ আরো বলেনঃ "মুসলমান হবার আগে ধর্ম কর্মই করতাম না। সম্ভবত আমি আমার সমগ্র জীবনে পাঁচ বারের মতো গির্যায় গেছি। আমার মা একটি ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। বাবার ফ্যামিলিতেও কেউ ছিলেন প্রোটেস্টান্ট কেউবা নাস্তিক। তারমানে কেউই প্রকৃত অর্থে ধর্মানুসারী ছিলেন না। সে কারণেই আমাদের ফ্যামিলিতে ধর্মীয় জীবনযাপনের তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। ইসলাম গ্রহণ করার আগে সবসময় ভাবতাম আমার হৃদয়ের বিশাল একটি টুকরো বুঝি হারিয়ে গেছে কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না সেটা কী! কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছিলো ইসলাম এবং তার শিক্ষার মাধুর্যের ফলে হৃদয়ের হারানো সেই অজানা বস্তুর অনুভব কমতে লাগলো। ২০০১ এর আঠারোই সেপ্টেম্বরে আমি মুসলমান হয়ে গেলাম। আমার হৃদয় হারানো বস্তু ফিরে পেলো। আমিও উপলব্ধি করলাম অন্তর আমার জীবন্ত হয়ে উঠলো, জীবন হয়ে উঠলো লক্ষ্যময়। আমার মাঝে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখে বাবা কৌতূহলি হয়েই ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলেন।"
লিণ্ডসি মুসলমান হবার পর হিজাব পরতে শুরু করেন। প্রথম যেদিন হিজাব পরেন সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেনঃ "যখন জানলাম হিজাব একটা ইসলামী বিধান ভাবলাম এটা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার, কিন্তু হিজাব পরার পর উপলব্ধি করতে লাগলাম এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে সবোর্ত্তম একটা নিয়ামত। প্রথম যেদিন হিজাব পরে বাইরে গেলাম, খুব গর্ব অনুভব করলাম। শব্দ দিয়ে সেই অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। নারীর জন্যে হিজাব সর্বোত্তম জিনিস। হিজাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হলো পুরুষদের সামনে সতীত্ব বা চারিত্রিক সৌন্দর্য রক্ষা করা এবং নিরাপত্তা ও প্রশান্তি অনুভব করা।" বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোতে যেভাবে মুসলমান হতে শুরু করেছে, তা থেকে বোঝা যায় পথচ্যুত মানবতা সর্বশেষ ঐশী দ্বীনের ছায়াতলে আসার জন্যে এবং গোমরাহী আর হতাশার অবসান ঘটানোর জন্যে কীরকম তৃষ্ণার্ত ছিল। এখন একদিকে মুসলমান হবার প্রবণতা অপরদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় পশ্চিমারা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সূরা বাকারার ৩৮ নম্বর আয়াতের একাংশে বলা হয়েছেঃ "...তোমাদের জন্যে যখন আমার পক্ষ থেকে হেদায়েত আসে,যারা তার অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই,তারা চিন্তিতও হবে না।"
মার্কিন রমনী লিন্ডসি কোনিগের ইসলাম গ্রহণ
মার্কিন নওমুসলিম লিন্ডসি কোনিগের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করবো আজকের আলোচনা। তিনি বলেছেনঃ "ইসলামের প্রতি ইমান আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর মুহূর্তটি ছিল আমার প্রতি আমার বাবার কৌতূহল।ধর্মের প্রতি তাঁর কোনো বিশ্বাস ছিল না।কিন্তু আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর আমার মাঝে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখে তিনি ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নিঃসন্দেহে এটা ছিল আল্লাহরই কাজ। কেননা আমার বাবার প্রতি এই যে অনুগ্রহ এটা অন্য কোনো কিছু কিংবা অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না।
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম ভীতি ছড়ানোর প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এর কারণ হলো টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোরকম তদন্ত বা পর্যালোচনা করা ছাড়াই মুসলমানদেরকে দায়ী করে। এভাবে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে প্রচারণা চালায় এমনকি সামরিক হামলা করতেও দ্বিধা করে নি। একটা অবাস্তব বিষয়কে তারা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে এতো বেশি প্রচারণা চালায় যে স্বয়ং পশ্চিমাদের মাঝেই ইসলাম বিষয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। এই কৌতূহল থেকে পাশ্চাত্যে ইসলাম এবং কোরআন সম্পর্কে জানার বা স্টাডি করার একটা জোয়ার আসে। ইউরোপ এবং আমেরিকার অধিকাংশ বই বিক্রেতাদের মাঝে কোরআন এবং ইসলামী সাহিত্য বিষয়ক বই বিক্রির হিড়িক লেগে যায়। ইসলাম বিষয়ক বই পুস্তক বিক্রি করে তারা ব্যাপক লাভবান হয়।
১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পরপরই মার্কিনীদের অসম্ভবরকম ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণার কারণেই পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে ইন্টারনেটে ইসলাম বিষয়ক তথ্য খোঁজার ধুম লেগে যায়। ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা পাঠকগণ পড়ালেখা করার পর ইসলামের ব্যাপারে বিদ্বেষী না হয়ে বরং তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে দেয়। ইসলাম সম্পর্কে গভীর উপলব্ধির কারণেই তাঁরা মানবিকতার সুষমামণ্ডিত এই ধর্মের ওপর ইমান আনে। এ ধরনের গভীর উপলব্ধি থেকে পশ্চিমা মুলুকে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাঁদেরই একজন হলেন লিন্ডসি ইয়াসমিন কোনিগ। ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে এই নও মুসলিম মহিলার নিজস্ব ভাষ্য হলোঃ
"আমার নাম হলো লিন্ডসি ইয়াসমিন কোনিগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ম্যাইন অঙ্গরাজ্যে আমি বাস করি। আমি ২০০১ সালের আঠারোই সেপ্টেম্বরে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হই। আমার মুসলমান হবার গল্প এরকমঃ
"ইহুদিদের ধর্ম আমাদের খ্রিষ্টান ধর্মের চেয়ে আলাদা। খ্রিষ্টধর্ম এবং ইহুদি ধর্ম দুটো মৌলিক ধর্ম..." এই দুটি বাক্য আমরা আমাদের ক্লাসের এক শিক্ষকের কাছে শুনেছি। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। আমি সরকারী স্কুলগুলোতে পড়ার সময় ইসলাম বিষয়ে এমনকি একটি শব্দও কখনো শুনি নি। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পরই টিভি পর্দায় সারাক্ষণ চোখ রাখতাম এবং তখনই ইসলাম ও মুসলমান শব্দগুলো কানে প্রবেশ করতে থাকে। তখনই খুব কৌতূহলী হয়ে উঠলাম মুসলমানদের সম্পর্কে। ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে গবেষণার ইচ্ছে জাগলো। ঠিক করলাম পুরোটা দিন এ নিয়ে স্টাডি করবো। তাই করলাম।
ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনে গিয়ে টাইপ করলাম 'মুসলিম'। সার্চ দিলাম। অমনি চোখের সামনে ভেসে উঠলো লাল,সাদা এবং নীল রঙের বিচিত্র লিংক। ইসলাম এবং মুসলমান শব্দগুলো সংবলিত সাইটের বিচিত্র অ্যাড্রেস বেরিয়ে এলো।প্রথম সাইটটিকে ঢুকলাম। ইসলাম সম্পর্কে এই সাইট থেকে বেশ কিছু জানলাম। এটুকুতেই বুঝতে পারলাম,পশ্চিমারা ইসলাম সম্পর্কে যেসব প্রচারণা চালায় সেসব প্রচারণার সাথে এর পার্থক্য প্রচুর।তাই আরো বেশি বেশি জানতে চাইলাম। ইতোমধ্যে মারিয়াম নামের মুসলিম একটি মেয়ের সাথে পরিচিত হলাম। এখানেই আমার ইসলাম গ্রহণের গল্পের প্রকৃত সূচনা হয়। মারিয়ামের সাথে সম্পর্ক গভীর হলো।ফলে তার কাছ থেকে সহযোগিতা পাবার সুযোগ হলো।
বিশেষ করে মার্কিন টিভি চ্যানেলগুলো দেখে দেখে বুঝতে পারলাম প্রচারণাগুলো পক্ষপাতদুষ্ট,তাই মনে আরো বেশি প্রশ্ন জাগতে লাগলো। মারিয়াম অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে লাগলো। সেইসাথে ইসলামের বিধিবিধান এবং শিক্ষাগুলো দিতে লাগলো। এইসব হুকুম আহকাম অবশ্য আমার কাছে খুব বেশি আকর্ষণীয় ছিল না। তবে দার্শনিক প্রজ্ঞা, আল্লাহর দয়াশীলতা, সুশৃঙ্ক্ষল কাঠামো সবোর্পরি ইসলামের আধ্যাত্মিকতা আমাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছিল।
লিন্ডসি কোনিগ আরো বলেনঃ "মুসলমান হবার আগে ধর্ম কর্মই করতাম না। সম্ভবত আমি আমার সমগ্র জীবনে পাঁচ বারের মতো গির্যায় গেছি। আমার মা একটি ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। বাবার ফ্যামিলিতেও কেউ ছিলেন প্রোটেস্টান্ট কেউবা নাস্তিক। তারমানে কেউই প্রকৃত অর্থে ধর্মানুসারী ছিলেন না। সে কারণেই আমাদের ফ্যামিলিতে ধর্মীয় জীবনযাপনের তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। ইসলাম গ্রহণ করার আগে সবসময় ভাবতাম আমার হৃদয়ের বিশাল একটি টুকরো বুঝি হারিয়ে গেছে কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না সেটা কী! কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছিলো ইসলাম এবং তার শিক্ষার মাধুর্যের ফলে হৃদয়ের হারানো সেই অজানা বস্তুর অনুভব কমতে লাগলো। ২০০১ এর আঠারোই সেপ্টেম্বরে আমি মুসলমান হয়ে গেলাম। আমার হৃদয় হারানো বস্তু ফিরে পেলো। আমিও উপলব্ধি করলাম অন্তর আমার জীবন্ত হয়ে উঠলো, জীবন হয়ে উঠলো লক্ষ্যময়। আমার মাঝে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখে বাবা কৌতূহলি হয়েই ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলেন।"
লিণ্ডসি মুসলমান হবার পর হিজাব পরতে শুরু করেন। প্রথম যেদিন হিজাব পরেন সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেনঃ "যখন জানলাম হিজাব একটা ইসলামী বিধান ভাবলাম এটা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার, কিন্তু হিজাব পরার পর উপলব্ধি করতে লাগলাম এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে সবোর্ত্তম একটা নিয়ামত। প্রথম যেদিন হিজাব পরে বাইরে গেলাম, খুব গর্ব অনুভব করলাম। শব্দ দিয়ে সেই অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। নারীর জন্যে হিজাব সর্বোত্তম জিনিস। হিজাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটা হলো পুরুষদের সামনে সতীত্ব বা চারিত্রিক সৌন্দর্য রক্ষা করা এবং নিরাপত্তা ও প্রশান্তি অনুভব করা।" বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোতে যেভাবে মুসলমান হতে শুরু করেছে, তা থেকে বোঝা যায় পথচ্যুত মানবতা সর্বশেষ ঐশী দ্বীনের ছায়াতলে আসার জন্যে এবং গোমরাহী আর হতাশার অবসান ঘটানোর জন্যে কীরকম তৃষ্ণার্ত ছিল। এখন একদিকে মুসলমান হবার প্রবণতা অপরদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় পশ্চিমারা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সূরা বাকারার ৩৮ নম্বর আয়াতের একাংশে বলা হয়েছেঃ "...তোমাদের জন্যে যখন আমার পক্ষ থেকে হেদায়েত আসে,যারা তার অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই,তারা চিন্তিতও হবে না।"
Subscribe to:
Posts (Atom)