Tuesday, 18 September 2012

সফর

শরীফ মুহাম্মদ

সতের বছর বয়স তখন। ফরিদাবাদ মাদরাসায় পড়ি। শরহে বেকায়া জামাতে। এ বছরেই এক সময় হঠাৎ বন্যার পদধ্বনি শোনা যেতে লাগলো। একেকদিন একেক জেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। খবর আসছে পত্র-পত্রিকায়। ঢাকার চারপাশে বন্যা। দেখতে দেখতে বুড়িগঙ্গাও যৌবন পেয়ে গেছে। ফুঁসে উঠে ড্রেন-নালা, খাল-ক্যানেল দিয়ে ঢাকা ঢুকে পড়ছে তার পানি।
একদিন ফজরের পর মাদরাসার ভেতরের ড্রেন দিয়ে দেখলাম একটু একটু পানি উঠছে মাঠে। উদ্বেগ ও আতঙ্কের চেয়ে উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য বোধ করলাম বেশি। কম বয়সের কারণে ও মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা হলে ছুটি প্রাপ্তির ঘোরে বন্যার ক্ষতিকর দিকটি মাথাতেই এলো না প্রথমে। ওই দিনই সকাল দশটার দিকে মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হলো। বলা হলো, যারা তাবলিগে যাবে, তারা যেন নাম লিখিয়ে দেয়। বুঝে না বুঝেই নাম দিয়ে দিলাম। এরপর দুপুরের আগে কাকরাইল ও বিকেলের মধ্যে আদমজী জুট মিলে।
তাবলিগ জামাতে সময় লাগানোর আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। তিনদিনের জামাত। কাকরাইল থেকে পাঁচ-ছয়জন যুক্ত হলেন। বাকিরা ছিলাম এক মাদরাসারই বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্র। এ ছিল অন্য রকম নিমগ্নতায় কৈশোরের শেষবেলা। আদমজী জুট মিলে থাকতে থাকতেই খবর পেলাম বন্যায় ডুবে যাচ্ছে সারাদেশ। উদ্বেগ চেপে বসলো। নিজেদের বিপন্নতার আশঙ্কার পাশাপাশি অন্যদের দুর্ভোগ ও অসহায়ত্ব নিয়েও মন খারাপ হতে লাগলো। তিনদিন শেষ হওয়ার পর যখন জামাতসহ বাসে ফিরছি তখন যাত্রাবাড়িতে এসে আমাদের মাদরাসার দলটি নেমে পড়লাম। নেমেই দেখলাম, চারদিকে পায়ে হাঁটা মানুষের স্রোত। ফরিদাবাদ পর্যন্ত যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। রাস্তাই নাকি নেই। চমকে উঠলাম। সেটি ছিল সেই আটাশির বন্যা।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই পোস্তগোলার দিকে গাট্টি-বোঁচকা মাথায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। জায়গায় জায়গায় দেখলাম, বালি ও সিমেন্টের বস্তা এনে সাধারণ মানুষ রাস্তার উপর ফেলছেন। উপরের অংশের পানি যেন এই নিম্নাঞ্চলে চলে না আসে সেজন্য রাস্তা এক পর্যায়ে আটকে দিয়ে হাজার হাজার মানুষ খাঁটাখাঁটুনি করছেন। পোস্তগোলায় যাওয়ার সময় রাস্তা থেকে বায়ে নেমে ম্যাচ ফ্যাক্টরির সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেলাম। দলবদ্ধ মানুষের স্রোতের সঙ্গে। এরপর পোস্তগোলা থেকে ফরিদাবাদে গেলাম কোমর সমান পানিতে ডুবে। একটি ভ্যানে সামানা তুলে তার চারপাশে ছিলাম আমরা। মাদরাসায় পৌঁছলাম সন্ধ্যার আগে। এরপর চারদিক ভুতুড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ফাঁকা মাদরাসায় সারারাত আমরা ক’জন ভয়ে ভয়ে কাটালাম। প্রাণভরে দুআ করলাম। নিজেদের বাড়িঘর ডুবে যাওয়া, বাসা বাড়িতে যেতে না পারার দুশ্চিন্তা নিয়ে অস্থির হয়ে আল্লাহর দরবারে কাঁদলাম।
পরদিন সকালে প্রথমে সদরঘাট ও পরে কমলাপুরে গিয়ে হাজির হলাম। একটা ট্রেন পেতে পেতে দুপুর ও ময়মনসিংহে গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা। ট্রেন থেকে নেমে বাসায় যাওয়ার পথে দেখলাম ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের প্রান্ত ছুঁয়ে আছে ব্রহ্মপুত্রের পানি। কোনো কোনো জায়গায় রাস্তা কিছুটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে আছে। রিক্সাচালককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, গত দু’দিন একটু একটু করে পানি চুয়ে চুয়ে শহরে ঢুকছিল। আজ বন্ধ। আজ থেকে বরং পানি একটু একটু কমছে। বাসায় গিয়ে পৌঁছার আগেই প্রশান্তি এসে ঠাঁই পেল মনে।
এরপর যখন বাসায় পৌঁছলাম তখন মনে হলো, বড় কোনো বিপর্যয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর আবার যেন পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে। আল্লাহ তাআলার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় হৃদয়-মন আপ্লুত হয়ে গেল। জীবনে প্রথম তাবলিগের সফরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল গভীর উৎকণ্ঠার ঘটনা। আবার সফর শেষের সঙ্গে ছিল প্রশান্তির অভূতপূর্ব অনুভূতি। এ উদ্বেগ ও প্রশান্তির কলকাঠি আমার হাতে ছিল না। ছিলাম কেবল ফলভোগী। আল্লাহ তাআলার কাছে আত্মসমর্পণ ও সাহায্য চাওয়ার সবক শেখায় তার দীনের মেহনত। এই মেহনতে নিমগ্নতার একটি প্রধান উপায় তাবলিগ জামাত। এ জামাতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আল্লাহ তাআলা সবাইকে দান করুন।

তাবলিগ, বিশ্বব্যাপী কার্যকর এক ইসলামি আন্দোলন



লিখেছেন হাবিবুল্লাহ ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১১



আখেরি নবী মুহাম্মদ সঃ এর পরে দীনের দাওয়াতের গুরু দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়ে উম্মতের উপর। দাওয়াতের কাজ করার কারণেই আল্লাহ তালা এই উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে ঘোষণা করেন।
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّـهِ তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। সুরা আলে ইমরান = ১১০
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّـهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎ কর্ম করে এবং বলে আমি একজন আজ্ঞাবহ তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার? সুরা ফুসসিলাত = ৩৩
যুগে যুগে মুসলমানদের মধ্যে দীনদার পরহেজগার ওলামা মাশায়েক, আলিয়ায়ে কেরাম তাবলীগের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ভারতের রাজস্থানের মেওয়াট নামক স্থান থেকে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুসলিহে মিল্লাত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ.) তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজেই এ কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায়ই এ মহত কার্যক্রম ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াছের (রহ.) মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) তাবলীগ জামাতের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভীও এ কার্যক্রমের প্রাণপুরুষ ছিলেন। মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) পরবর্তী সময়ে তাবলীগ জামাতের অন্যতম আমির বা নেতা ছিলেন। বাংলাদেশে তাবলীগ জমাতের আজীবন আমির ছিলেন মাওলানা আব্দুল আজিজ (রহ.)। তিন-চার দশকের মধ্যেই তাবলীগের কার্যক্রম সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তার লাভ করে এবং ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

৬ টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর বিশেষ তাগিদ সহকারে আমল করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হলেও জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ দীনের উপর আমল করার করার প্রতি উৎসাহিত করা হয় । জোর নয়, নরম স্বভাব, উন্নত চরিত্র, মার্জিত আচরণ এর মাধ্যমে হেকমতের সহিত মানুষকে দীনের প্রতি ডাকা , সর্বোপরি সুন্নাতের উপর আমল করার মাধ্যমে আল্লাহ তালার সন্তুষ্টি অর্জন করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে। সুরা নাহাল = ১২৫

তাবলীগ জামাতের বিশেষ একটি গুণ হচ্ছে তারা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে দীনের দাওয়াতের কাজ করে। কারো কাছ থেকে টাকা পয়সা নেয় না। ছওয়াল করেন, এবং ছওয়ালের ভানও করে না। কোরানের এই আয়াতের সাথে হুবহু মিলে যায় তাদের এই গুনটি। আল্লাহ তালা বলেন اتَّبِعُوا مَن لَّا يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُم مُّهْتَدُونَ অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় কামনা করে না, অথচ তারা সুপথ প্রাপ্ত। সুরা ইয়াছীন =২১

পরিবেশ অনুকূল হোক আর প্রতিকুল হোক বিশ্বের প্রায় সব কটি দেশেই তাবলীগের দাওয়াতি কাজ চলছে আলহামদুলিল্লাহ। এটা নিশ্চয় তাদের এখলাছের কারণে আল্লাহর বিশেষ রহমতে সম্ভব হচ্ছে। এবং তাবলীগের দাওয়াতি কাজের ফলে অমুসলিম মুসলমান হচ্ছে আর মুসলমানগণ দীনের প্রতি আরোবেশি আগ্রহী হচ্ছে। সুন্নাত মতে আমল করা শিখছে।
দাওয়াতের কাজ করা বর্তমানে কতটা জরুরী তা দেখে নিতে পারেন এই খানে
তারা বলে থাকেন ৬ টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব সহকারে আমল করতে পারলে দীনের অন্য সব বিষয়ে আমল করা সহজ হয়ে যায়।
যে বিষয় গুলির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় তা হল
১/ কালেমা ২/ নামাজ ৩/ এলম ও জিকির ৪/ ইকরামুল মুসলিমীন ৫/ তাসহীহে নিয়ত ৬/ তাবলীগ।

এই বিষয় গুলির প্রত্যেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১/ কালেমা। لا اله الا الله محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم
অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনও ইলাহ নাই, মুহাম্মদ [সঃ] আল্লাহর রসুল।
কালেমা থেকে পরিপূর্ণ ঈমান বুঝানো হয়ে থাকে। তাবলীগ ওয়ালারা এর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাতে শিরক থেকে বাছার জন্য এবং প্রকৃত ইমানের পরিচয় তুলে ধরার জন্য বলে থাকেন , আল্লাহ তালা ছাড়া অন্য যা কিছু আমরা দেখি বা না দেখি সব জিনিসই মাখলুখ। মাখলুখ কিছুই করতে পারে না আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া । আর আল্লাহ তালা সব কিছুই করতে পারেন মাখলুখের সাহায্য ছাড়া।

ঈমানে মুফাসসালের ঘোষণা অনুযায়ী ৭টি জিনিসের প্রতি ঈমান আনতে হয়। (১) আল্লাহ, (২) ফেরেশতাগণ (আ.), (৩) কিতাবসমূহ, (৪) রসূলগণ, (৫) আখেরাত, (৬) ভাগ্যে ভালমন্দ যা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে অর্থাৎ তাকদির ও (৭) মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান। ঈমান অর্থ শুধু বিশ্বাস নয়, বরং অন্তরে বিশ্বাস, মুখে ঘোষণা এবং বাস্তবে কাজে পরিণত করার নামই হচ্ছে ঈমান।

ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে , কারো কথাকে তার বিশ্বস্ততার নিরিখে মনে - প্রাণে মেনে নেয়া । অপর দিকে রসূল ( সা: ) - এর কোন সংবাদ কেবলমাত্র রসূলের উপর বিশ্বাসবশতঃ মেনে নেয়াকে শরিয়তের পরিভাষায় ঈমান বলে । যুহাইর ইবনে হরব ( রঃ ) আবু হোরায়রা থেকে রেওয়ায়ত করেছেন , রসূলে পাক ( সা: ) এরশাদ করেছেন , ঈমানের শাখা সত্তরটির ও বেশি অথবা ষাটটির কিছু বেশি । এর সর্বোচ্চ শাখা হল লা ইলাহা ইল্লাললাহ ( অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত মাবুদ নাই ) এই কথা স্বীকার করা আর সর্বনিম্ন শাখা হল পথের উপর থেকে ক্লেশ দায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা । আর লজ্জা হল ঈমানের বিশেষ শাখা সমূহের অন্যতম । ( মুসলিম )

ঈমানের শাখা সমূহের বর্ণনা: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা , আল্লাহ পাক ব্যতিরেকে বাকী সব আল্লাহর সৃষ্ট ( মখলুক ) ও ধ্বংসশীল এ বিশ্বাস করা , সমস্ত পয়গম্বরদের প্রতি ঈমান আনয়ন , ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনয়ন , আল্লাহর নাযিল কৃত সমস্ত কিতাবের প্রতি ঈমান আনয়ন , কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন , তাকদিরের প্রতি ঈমান আনয়ন , মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়ার উপর বিশ্বাস , জান্নাতকে বিশ্বাস করা , জাহান্নামকে বিশ্বাস করা , আল্লাহর সহিত ভালবাসা রাখা , আল্লাহর সন্তুষ্টি কল্পে কাউকে ভালবাসা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কল্পে কারো উপর অসন্তুষ্টি হওয়া , রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের সহিত ভালবাসা রাখা , একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহর ইবাদত করা , আল্লাহর কাছে তওবা করা , আল্লাহর উপর আশা রাখা , লজ্জাশীলতা , আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা , অঙ্গীকার পূরণ করা , ধৈর্যধারণ করা , বিনয়ী হওয়া , আল্লাহর সৃষ্ট সকল মখলুকের উপর স্নেহ ও দয়া , আল্লাহর ফয়সালার উপর রাজী হওয়া , আল্লাহর উপর ভরসা করা , স্বৈরচারিতা বর্জন করা , গোস্বা পরিহার করা , কুঅভ্যাস পরিহার করা , দুনিয়ার মহব্বত পরিহার করা । কালিমা তাওহীদ পাঠ করা , কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করা , ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা , ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয়া , দুয়া করা , যিকির করা , বেহুদা ও নিষিদ্ব কথাবার্তা হতে বেঁচে থাকা , পবিত্রতা অর্জন করা , নামাজ কায়েম করা , সদকা আদায় করা , নিজের দ্বীন রক্ষার্থে কোথা ও পালিয়ে যওয়া , ইতিকাফ করা , হজ্জ করা , মান্নত পূরন করা , কসমের প্রতি খেয়াল রাখা , কাফফারা আদায় করা , সতর ঢেকে রাখা , কুরবানী করা , ঋণ পরিশোধ করা , লেনদেনে ন্যায় - নীতি বজায় রাখা , শরীয়ত বিরোধী কাজ হতে বেচে থাকা , সত্য সাক্ষ্য দেওয়া , কাপন - দাপনের ব্যবস্হা করা , বিবাহ করে সতীত্ব অর্জন করা , পরিবার পরিজনের হক আদায় করা , মাতা - পিতার খিদমত করা ও তাদের কষ্ট না দেয়া , মনিবের অনুগত হওয়া , বিচারে ন্যায় নীতি অবলম্বন করা , মুসলিম জামাতের অনুসরণ করা , শাসকের অনুসরণ করা , মানুষের মাঝে সংশোধন করে দেওয়া , ভাল কাজে সাহায্য করা ও মন্দ কাজে সাহায্য না করা , সত্য কথা বলা , মন্দ কথা হতে নিষেধ করা , দণ্ড বিধি প্রতিষ্ঠা করা , আমানত আদায় করা , অভাবী বা বিপদের সম্মুখীনকে ধার দেওয়া , সন্তোষজনক মুআমিলা করা , প্রতিবেশীর সহিত সুন্দর ব্যবহার করা , মাল যথা স্থানে খরচ করা , সালামের জবাব দেয়া , হাঁচি দাতার জবাবে ইয়ার হামু কাল্লাহ বলা , বেহুদা খেল তামাসা হতে বেঁচে থাকা , মানুষের ক্ষতি না করা , কষ্টদায়ক জিনিস রাস্তা হতে অপসারণ করা ।
বাকি বিষয় গুলি পরে আলোচনা করার আশা রাখি ইনশা আল্লাহ।

যে চৌদ্দ আমলে রিজিক বাড়ে

আলী হাসান তৈয়ব

মুসলিম মাত্রেই বিশ্বাস করেন যে তার আয় ও উপার্জন, জীবন ও মৃত্যু, এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য ইত্যাদি র্নিধারণ হয়ে যায় যখন তিনি মায়ের উদরে থাকেন। আর এসব তিনি লাভ করেন তার জন্য বরাদ্দ উপায়-উপকরণগুলোর মাধ্যমে। তাই আমাদের কর্তব্য হলো হাত গুটিয়ে বসে না থেকে এর জন্য র্নিধারিত উপায়-উপকরণ সংগ্রহে চেষ্টা করা। যেমন চাষাবাদ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প-চারু, চাকরি-বাকরি বা অন্য কিছু। আল্লাহ তা‌‘আলা বলেন,
‘তিনিই তো তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা এর পথে প্রান্তরে বিচরণ কর এবং তাঁর রিযক থেকে তোমরা আহার কর। আর তাঁর নিকটই পুনরুত্থান।’ {সূরা আল-মুলক, আয়াত : ১৫} আজ আমরা রিজিক বৃদ্ধির উপায়সমূহের মধ্যে কুরআন ও হাদীস রোমন্থিত ১৪টি আমলের কথা আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
**প্রথম আমল : তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল অবলম্বন করা।
আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়া অবলম্বন করা, তাঁর নির্দেশাবলি পালন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বর্জন করা। পাশাপাশি আল্লাহর ওপর অটল আস্থা রাখা, তাওয়াক্কুল করা এবং রিজিক তালাশে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা। কারণ, যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ‌
‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।’ {সূরা আত-তালাক, আয়াত : ২-৩}
অর্থাৎ যে আল্লাহকে ভয় করবে এবং আনুগত্য দেখাবে, আল্লাহ তার সকল সংকট দূর করে দেবেন এবং তার কল্পনাতীত স্থান থেকে রিজিকের সংস্থান করে দেবেন। আর যে কেউ তার উদ্দেশ্য হাসিলে একমাত্র আল্লাহর শরণাপন্ন হয় তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। বলাবাহুল্য এই তাকওয়ার পরিচয় মেলে হালাল উপার্জনে চেষ্টা এবং সন্দেহযুক্ত কামাই বর্জনের মধ্য দিয়ে।
**দ্বিতীয় আমল : তাওবা ও ইস্তেগফার করা ।
অধিক পরিমাণে ইস্তেগফার এবং বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও রিজিক বাড়ে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অন্যতম নবী ও রাসূল নূহ আলাইহিস সালামের ঘটনা তুলে ধরে ইরশাদ করেন,
‘আর বলেছি, ‘তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল’। (তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলে) ‘তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, ‘আর তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালা’। {সূরা নূহ, আয়াত : ১০-১২} হাদীসে বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বলা হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন।’ [আবূ দাঊদ : ১৫২০; ইবন মাজা : ৩৮১৯; তাবরানী : ৬২৯১] অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ [বাইহাকী : ৬৩৬; হাকেম, মুস্তাদরাক : ৭৬৭৭ সহীহ সূত্রে বর্ণিত।]
**তৃতীয় আমল : আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা ।
আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের হক আদায়ের মাধ্যমেও রিজিক বাড়ে। যেমন : আনাস ইবন মালেক রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত করে দেওয়া হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ করা হোক সে যেন তার আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে।’ [বুখারী : ৫৯৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৯]
**চতৃর্থ আমল : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরূদ পড়া।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরূদ পাঠেও রিজিকে প্রশস্ততা আসে। যেমনটি অনুমিত হয় নিম্নোক্ত হাদীস থেকে। তোফায়েল ইবন উবাই ইবন কা‘ব রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন,আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনার প্রতি অধিকহারে দরূদ পড়তে চাই, অতএব আমার দু‘আর মধ্যে আপনার দরূদের জন্য কতটুকু অংশ রাখব? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও। কা‘ব বলেন, আমি বললাম, এক চতুর্থাংশ। তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও। তবে যদি তুমি বেশি পড় তা তোমার জন্য উত্তম হবে। আমি বললাম, অর্ধেক? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও। তবে তুমি যদি বেশি পড় তা তোমার জন্য উত্তম হবে। কা‘ব বলেন, আমি বললাম, তাহলে দুই তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও। তবে তুমি যদি বেশি পড় তা তোমার জন্য উত্তম হবে। আমি বললাম, আমার দু‘আর পুরোটা জুড়েই শুধু আপনার দরূদ রাখব। তিনি বললেন, তাহলে তা তোমার ঝামেলা ও প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট হবে এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা করা হবে। [তিরমিযী : ২৬৪৫; হাকেম, মুস্তাদরাক : ৭৬৭৭ (আবূ ঈসা বলেন, হাদীসটি ‘হাসান’ সহীহ।)]
**পঞ্চম আমল : আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা ।
আল্লাহর রাস্তায় কেউ ব্যয় বা দান করলে তা বিফলে যায় না। সে সম্পদ ফুরায়ও না। বরং তা বাড়ে বৈ কি। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ‘বল, ‘নিশ্চয় আমার রব তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা রিযক প্রশস্ত করেন এবং সঙ্কুচিত করেন। আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্য ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দেবেন এবং তিনিই উত্তম রিযকদাতা।’ {সূরা আস-সাবা’, আয়াত : ৩৯}
**ষষ্ঠ আমল : বারবার হজ-উমরা করা ।
হজ ও উমরা পাপ মোচনের পাশাপাশি হজকারী ও উমরাকারীর অভাব-অনটন দূর করে এবং তার সম্পদ বাড়িয়ে দেয়। আবদুল্লাহ ইব্ন মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা হজ ও উমরা পরপর করতে থাক, কেননা তা অভাব ও গুনাহ দূর করে দেয়, যেমন দূর করে দেয় কামারের হাপর লোহা, সোনা ও রুপার ময়লাকে।’ [তিরমিযী : ৮১৫; নাসাঈ : ২৬৩১]
**সপ্তম আমল : দুর্বলের প্রতি সদয় হওয়া বা সদাচার করা ।
মুস‘আব ইবন সা‘দ রাদিআল্লাহু আনহু যুদ্ধজয়ের পর মনে মনে কল্পনা করলেন, তিনি বোধ হয় তাঁর বীরত্ব ও শৌর্য-বীর্য হেতু অন্যদের চেয়ে নিজেকে বেশি মর্যাদাবান। সেই প্রেক্ষিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে থাকা দুর্বলদের কারণে কেবল তোমাদের সাহায্য করা হয় এবং রিজিক প্রদান করা হয়।’ [বুখারী : ২৮৯৬]
**অষ্টম আমল : ইবাদতের জন্য ঝঞ্ঝাটমুক্ত হওয়া ।
আল্লাহর ইবাদতের জন্য ঝামেলামুক্ত হলে এর মাধ্যমেও অভাব দূর হয় এবং প্রাচুর্য লাভ হয়। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে আদম সন্তান, আমার ইবাদতের জন্য তুমি ঝামেলামুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র ঘুচিয়ে দেব। আর যদি তা না কর, তবে তোমার হাত ব্যস্ততায় ভরে দেব এবং তোমার অভাব দূর করব না।’ [তিরমিযী : ২৬৫৪; মুসনাদ আহমদ : ৮৬৮১; ইবন মাজা : ৪১০৭]
**নবম আমল : আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করা।
আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে হিজরত তথা স্বদেশ ত্যাগ করলে এর মাধ্যমেও রিজিকে প্রশস্ততা ঘটে। যেমনটি অনুধাবিত হয় নিচের আয়াত থেকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যে আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করবে, সে যমীনে বহু আশ্রয়ের জায়গা ও সচ্ছলতা পাবে। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে মুহাজির হয়ে নিজ ঘর থেকে বের হয় তারপর তাকে মৃত্যু পেয়ে বসে, তাহলে তার প্রতিদান আল্লাহর উপর অবধারিত হয়। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ১০০}
আয়াতের ব্যাখ্যা আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস প্রমুখ সাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুদ বলেন, স্বচ্ছলতা অর্থ রিজিকে প্রশস্ততা।
**দশম আমল : আল্লাহর পথে জিহাদ।
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জিহাদেও সম্পদের ব্যপ্তি ঘটে। গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মাধ্যমে সংসারে প্রাচুর্য আসে। যেমন ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘আর আমার রিজিক রাখা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে।’ [মুসনাদ আহমদ : ৫৬৬৭; বাইহাকী : ১১৫৪; শু‘আবুল ঈমান : ১৯৭৮৩]
**একাদশ আমল : আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা ।
সাধারণভাবে আল্লাহ যে রিজিক ও নিয়ামতরাজি দান করেছেন তার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া করা এবং তাঁর স্তুতি গাওয়া। কারণ, শুকরিয়ার ফলে নেয়ামত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ‘আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।’ {সূরা ইবরাহীম, আয়াত : ০৭} আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা শুকরিয়ার বদৌলতে নেয়ামত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। আর বলাবাহুল্য আল্লাহর বাড়ানোর কোনো সীমা-পরিসীমা নাই।
**দ্বাদশ আমল : বিয়ে করা।
আজকাল মানুষের দুনিয়ার প্রাচুর্য ও বিলাসের প্রতি আসক্তি এত বেশি বেড়েছে, তারা প্রচুর অর্থ নেই এ যুক্তিতে প্রয়োজন সত্ত্বেও বিয়ে বিলম্বিত করার পক্ষে রায় দেন। তাদের কাছে আশ্চর্য লাগতে পারে এ কথা যে বিয়ের মাধ্যমেও মানুষের সংসারে প্রাচুর্য আসে। কারণ, সংসারে নতুন যে কেউ যুক্ত হয়, সে তো তার জন্য বরাদ্দ রিজিক নিয়েই আসে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা তোমাদের মধ্যকার অবিবাহিত নারী-পুরুষ ও সৎকর্মশীল দাস দাসীদের বিবাহ দাও। তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী।’ {সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩২} উমর ইবন খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহুমা বলতেন, ওই ব্যক্তির ব্যাপার বিস্ময়কর যে বিয়ের মধ্যে প্রাচুর্য খোঁজে না। কারণ স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা অভাবী হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন।’
**ত্রয়োদশ আমল : অভাবের সময় আল্লাহমুখী হওয়া এবং তার কাছে দু‘আ করা ।
রিজিক অর্জনে এবং অভাব দূরীকরণে প্রয়োজন আল্লাহর কাছে দু‘আ করা। কারণ, তিনি প্রার্থনা কবুল করেন। আর আল্লাহ তা‘আলাই রিজিকদাতা এবং তিনি অসীম ক্ষমতাবান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমাদের রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব।’ {সূরা আল-মু‘মিন, আয়াত : ৬০} এ আয়াতে আল্লাহ দু‘আ করার নির্দেশ দিয়েছেন আর তিনি তা কবুলের জিম্মাদারি নিয়েছেন। যাবৎ না তা কবুলে পথে কোনো অন্তরায় না হয়। যেমন ওয়াজিব তরক করা, হারাম কাজে জড়ানো, হারাম আহার গ্রহণ বা হারাপ পরিচ্ছদ পরা ইত্যাদি এবং কবুলকে খানিক বিলম্বিতকরণ। আল্লাহর কাছে দু‘আয় বলা যেতে পারে, ‘হে রিজিকদাতা আমাকে রিজিক দান করুন, আপনি সর্বোত্তম রিজিকদাতা। হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে পবিত্র সুপ্রশস্ত রিজিক চাই। হে ওই সত্তা, দানের ঢল সত্ত্বেও যার ভাণ্ডারে কমতি হয় না। হে আল্লাহ, আমাকে আপনি আপনার হালাল দিয়ে আপনার হারাম থেকে যথেষ্ট করে দিন আর আপনার দয়া দিয়ে আপনি ছাড়া অন্যদের থেকে যথেষ্ট হয়ে যান। হে আল্লাহ আপনি আমাকে যে রিজিক দিয়েছেন তা দিয়েই সন্তুষ্ট বানিয়ে দিন। আর যা আমাকে দিয়েছেন তাতে বরকত দিন।’ অভাবকালে মানুষের কাছে হাত না পেতে আল্লাহর শরণাপন্ন হলে এবং তাঁর কাছেই প্রাচুর্য চাইলে অবশ্যই তার অভাব মোচন হবে এবং রিজিক বাড়ানো হবে। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি অভাবে পতিত হয়, অতপর তা সে মানুষের কাছে সোপর্দ করে (অভাব দূরিকরণে মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়), তার অভাব মোচন করা হয় না। পক্ষান্তরে যে অভাবে পতিত হয়ে এর প্রতিকারে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হয় তবে অনিতবিলম্বে আল্লাহ তাকে তরিৎ বা ধীর রিজিক দেবেন। [তিরমিযী : ২৮৯৬; মুসনাদ আহমদ : ৪২১৮]
**চতুর্দশ আমল : গুনাহ ত্যাগ করা, আল্লাহর দীনের ওপর সদা অটল থাকা এবং নেকীর কাজ করে যাওয়া।
গুনাহ ত্যাগ করা, আল্লাহর দীনের ওপর অটল থাকা এবং নেকীর কাজ করা- এসবের মাধ্যমেও রিজিকের রাস্তা প্রশস্ত হয় যেমন পূর্বোক্ত আয়াতগুলো থেকে অনুমান করা যায়।
তবে সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা দুনিয়াতে চিরদিন থাকার জন্য আসি নি। তাই দুনিয়াকে প্রাধান্য না দিয়ে উচিত হবে আখিরাতকে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দেয়া। আমাদের এদেন অবস্থা দেখে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম ও স্থায়ী।’ {সূরা আল-আ‘লা, আয়াত : ১৬-১৭} আর পরকালের মুক্তি ও চিরশান্তিই যার প্রধান লক্ষ্য তার উচিত হবে রিজিকের জন্য হাহাকার না করে অল্পে তুষ্ট হতে চেষ্টা করা। যেমন : হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আ‘স রাদিআল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ওই ব্যক্তি প্রকৃত সফল যে ইসলাম গ্রহণ করেছে আর তাকে জীবন ধারণে (অভাবও নয়; বিলাসও নয়) পর্যাপ্ত পরিমাণ রিজিক দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তাতে তুষ্টও করেছেন। [মুসলিম : ২৪৭৩; তিরমিযী : ২৩৪৮; আহমদ : ৬৫৭২]
পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের এসব উপায়-উপকরণ যোগাড় করে রিজিক তথা হালাল উপার্জনে উদ্যোগী ও সফল হবার তাওফীক দান করেন। তিনি যেন আপনাদের রিজিক ও উপার্জনে প্রশস্ততা দান করেন। আমীন।



সৌজন্যে: ইসলামহাউস ডটকম

মানব কল্যাণে তাবলিগ










সৈয়দ শামছুল হুদা/
সমকাল ২১ জানুয়ারী.২০১১

বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এক বিশাল আয়োজন। এর উপকারিতা, ব্যাপকতা, বিস্তৃতি, সুফল এবং সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটি মতই লক্ষ্য করা যায়।

এ দেশের মানুষের ধর্মীয় আবেগ এবং অনুশীলন অনেক মুসলিম দেশের চেয়ে উন্নত। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়া এবং উত্তরোত্তর বিস্তৃতি নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কিছু লোককে এই নিয়ে নেতিবাচক কথা বলতে শোনা যায়। প্রকৃতপক্ষে দাওয়াতে তাবলিগ নিয়ে এ দেশে যে কাজ বর্তমানে চলছে এবং ইজতেমার মতো একটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে এর যে গুরুত্ব জানান দিচ্ছে এর মধ্যে কতটুকু সুফল আসছে, তা আজকের আলোচনার বিষয় বৈকি।

কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, বিশ্ব ইজতেমার কারণে মানুষের কষ্ট বাড়ে, রাস্তায় যানজট হয়, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে, তাবলিগওয়ালারা কোনো আন্দোলনের কথা বলে না, তারা শুধু গাঁট্টাগোট্টা নিয়ে মসজিদ নষ্ট করে। অনেকে বলেন, মুসলমানদের দাওয়াত দিয়ে লাভ কী? তাবলিগওয়ালারা অমুসলমানদের গিয়ে দাওয়াত দেয় না কেন? প্রকৃতপক্ষে তাবলিগ জাতিকে কী উপহার দিচ্ছে, একবার কি এর গভীরে গিয়ে কেউ উপলব্ধি করেছি? তাবলিগের সামাজিক ভিত্তির কথা কি একবার ভেবে দেখেছি?

দাওয়াত হয় এক জায়গায়, প্রভাব পড়ে ভিন্ন জায়গায়_ এ রূপ কারিশমা কি আমরা অনুভব করতে পারছি? তাবলিগ শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে কী প্রভাব বিস্তার করছে? ছেলে-বুড়োর মধ্যে কী জাদুময়তার ঢেউ দোলাচ্ছে? এ দাওয়াতি মিশন কী কী কাজ সমাধা করছে তা আমরা ক'জন অনুভব করতে পারি? তাবলিগের দাওয়াতি কার্যক্রম, এর ফলাফল, সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে আমরা ক'জন জ্ঞান রাখি। আজকে অনেকে অজ্ঞতাবশত হিংসা থেকে তাবলিগের বিরোধিতা করছে। আবার কেউ কেউ দাওয়াতে তাবলিগের নামে চলা এ মেহনতকে নিজের পছন্দমতো কাজে ব্যবহার করতে না পারার আক্রোশ থেকে তাবলিগের বিরোধিতা করে। মূলত দাওয়াতে তাবলিগ এমন একটি মিশন, যার প্রভাব তাৎক্ষণিক লক্ষ্য করা না গেলেও এর প্রভাব যুগ যুগ ধরে পড়তে থাকে। ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করে এই দাওয়াতে তাবলিগের ওপর। যতদিন দ্বীনের দাওয়াত থাকবে ততদিন দ্বীন থাকবে।

হজরত ইলিয়াস (রহ.) দিলের দরদ থেকে এ পদ্ধতি চালু করেন। তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপট, মানুষের ধর্মীয় অবস্থা, আচার-আচরণ থেকে ইসলাম যে কত দূরে চলে গিয়েছিল যারা তখনকার সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখেন তারা অনুভব করেন যে, আল্লামা ইলিয়াস (রহ.) যে পদ্ধতি তখন চালু করেছেন এখন পর্যন্ত এর চেয়ে উন্নত কোনো পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। হলে ওলামায়ে-কেরাম তাকে অবশ্যই সমর্থন করতেন। বর্তমান প্রচলিত তাবলিগের পৃষ্ঠপোষকতা এ দেশের ওলামায়ে-কেরাম করছেন। কারণ এর দ্বারা সব শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রভূত কল্যাণ হচ্ছে। যতদিন এর দ্বারা জাতি উপকৃত হবে, ততদিন এর সঙ্গে ওলামায়ে-কেরাম তাকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাবে।

বর্তমান দাওয়াতে তাবলিগের দ্বারা সবচেয়ে বড় যে উপকারটি হচ্ছে তা হলো, এর দ্বারা সব পেশা, শ্রেণী, বয়সের মানুষের সমাবেশ ঘটানো। দাওয়াতে তাবলিগের মাধ্যমে একজন বয়স্ক লোকও দ্বীন শিখতে পারেন। একজন অতি উঁচু পর্যায়ের শিক্ষিত, যিনি দ্বীন সম্পর্কে কোনো জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাননি তাকেও এর মাধ্যমে দ্বীনের জ্ঞান দান করা যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যে জনবহুল দেশ, এই দেশে সব মানুষকে দ্বীনের পথে আনার, এর চেয়ে উত্তম পথ আর কী আছে? দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কতজন লোককে দ্বীনের জ্ঞান দান করা সম্ভব? আজকে দাওয়াতে তাবলিগের সঙ্গে সব দল সমর্থন দিচ্ছে, সময় দিচ্ছে, সুযোগ হলেই তারা ছুটে আসছে বিশ্ব ইজতেমায়, তিনদিনে, একচিল্লায় বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আল্লাহর রাস্তায়। এ পথ কে বের করে দিয়েছে? এই তাবলিগের মাধ্যমেই তো সম্ভব হয়েছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা দাওয়াতের এক বিরাট সুযোগ। এর মাধ্যমে অনেক কিছু শেখার আছে। ইজতেমা উপলক্ষে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে মুসলমানরা আসছেন, তাদের দেখে, তাদের সঙ্গে মিশে আমরা যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একটি সম্প্রদায়ের অংশ তা কি উপলব্ধি করতে পারছি না? বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা লোকগুলো আমাদের আতিথেয়তা লাভ করে তাদের দেশে গিয়ে আমাদের দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। বিশ্ব পরিচিতির ক্ষেত্রে এ এক বিরাট সুযোগ। বিশ্ব ইজতেমা আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশ ও জাতির পরিচয় বিশ্বের দরবারে অনেক উঁচু করে তুলে ধরছে। বিশ্ব ইজতেমা আমাদের গৌরবের একটি অংশ হয়ে গেছে। মানুষের কল্যাণে, হেদায়েতের আলোকবর্তিকা বিস্তারে এর চেয়ে উন্নত বিকল্প এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। বিশ্ব ইজতেমাকে আরও সুন্দর, আরও সফল করার জন্য আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের সবার সর্বোচ্চ সামর্থ্যটুকু উজাড় করে দিয়ে বিশ্ব ইজতেমাকে সফল করতে হবে। বিদেশ থেকে যারা আসছেন তাদের সামনে ইতিবাচক বাংলাদেশ তুলে ধরতে হবে। তারা আমাদের দেশে প্রতিটি দেশের একেকজন রাষ্ট্রদূত। আজকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে নেতিবাচক, ষড়যন্ত্রমূলক কথা ছড়ানো হচ্ছে তা দূর করার অন্যতম একটি পথ হতে পারে এই বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে আমাদের দেশে মুসলমান ভাইয়েরা আসেন, তাদের মেহমানদারি, রাস্তাঘাটে তাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার মন নিয়ে আমরা বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করব। এর মাধ্যমে দেশের প্রভূত কল্যাণ হবে।

alhuda_wf@yahoo.com