
সৈয়দ শামছুল হুদা/
সমকাল ২১ জানুয়ারী.২০১১
বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এক বিশাল আয়োজন। এর উপকারিতা, ব্যাপকতা, বিস্তৃতি, সুফল এবং সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটি মতই লক্ষ্য করা যায়।
এ দেশের মানুষের ধর্মীয় আবেগ এবং অনুশীলন অনেক মুসলিম দেশের চেয়ে উন্নত। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়া এবং উত্তরোত্তর বিস্তৃতি নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কিছু লোককে এই নিয়ে নেতিবাচক কথা বলতে শোনা যায়। প্রকৃতপক্ষে দাওয়াতে তাবলিগ নিয়ে এ দেশে যে কাজ বর্তমানে চলছে এবং ইজতেমার মতো একটি আয়োজনের মধ্য দিয়ে এর যে গুরুত্ব জানান দিচ্ছে এর মধ্যে কতটুকু সুফল আসছে, তা আজকের আলোচনার বিষয় বৈকি।
কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, বিশ্ব ইজতেমার কারণে মানুষের কষ্ট বাড়ে, রাস্তায় যানজট হয়, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে, তাবলিগওয়ালারা কোনো আন্দোলনের কথা বলে না, তারা শুধু গাঁট্টাগোট্টা নিয়ে মসজিদ নষ্ট করে। অনেকে বলেন, মুসলমানদের দাওয়াত দিয়ে লাভ কী? তাবলিগওয়ালারা অমুসলমানদের গিয়ে দাওয়াত দেয় না কেন? প্রকৃতপক্ষে তাবলিগ জাতিকে কী উপহার দিচ্ছে, একবার কি এর গভীরে গিয়ে কেউ উপলব্ধি করেছি? তাবলিগের সামাজিক ভিত্তির কথা কি একবার ভেবে দেখেছি?
দাওয়াত হয় এক জায়গায়, প্রভাব পড়ে ভিন্ন জায়গায়_ এ রূপ কারিশমা কি আমরা অনুভব করতে পারছি? তাবলিগ শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে কী প্রভাব বিস্তার করছে? ছেলে-বুড়োর মধ্যে কী জাদুময়তার ঢেউ দোলাচ্ছে? এ দাওয়াতি মিশন কী কী কাজ সমাধা করছে তা আমরা ক'জন অনুভব করতে পারি? তাবলিগের দাওয়াতি কার্যক্রম, এর ফলাফল, সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে আমরা ক'জন জ্ঞান রাখি। আজকে অনেকে অজ্ঞতাবশত হিংসা থেকে তাবলিগের বিরোধিতা করছে। আবার কেউ কেউ দাওয়াতে তাবলিগের নামে চলা এ মেহনতকে নিজের পছন্দমতো কাজে ব্যবহার করতে না পারার আক্রোশ থেকে তাবলিগের বিরোধিতা করে। মূলত দাওয়াতে তাবলিগ এমন একটি মিশন, যার প্রভাব তাৎক্ষণিক লক্ষ্য করা না গেলেও এর প্রভাব যুগ যুগ ধরে পড়তে থাকে। ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করে এই দাওয়াতে তাবলিগের ওপর। যতদিন দ্বীনের দাওয়াত থাকবে ততদিন দ্বীন থাকবে।
হজরত ইলিয়াস (রহ.) দিলের দরদ থেকে এ পদ্ধতি চালু করেন। তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপট, মানুষের ধর্মীয় অবস্থা, আচার-আচরণ থেকে ইসলাম যে কত দূরে চলে গিয়েছিল যারা তখনকার সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখেন তারা অনুভব করেন যে, আল্লামা ইলিয়াস (রহ.) যে পদ্ধতি তখন চালু করেছেন এখন পর্যন্ত এর চেয়ে উন্নত কোনো পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। হলে ওলামায়ে-কেরাম তাকে অবশ্যই সমর্থন করতেন। বর্তমান প্রচলিত তাবলিগের পৃষ্ঠপোষকতা এ দেশের ওলামায়ে-কেরাম করছেন। কারণ এর দ্বারা সব শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রভূত কল্যাণ হচ্ছে। যতদিন এর দ্বারা জাতি উপকৃত হবে, ততদিন এর সঙ্গে ওলামায়ে-কেরাম তাকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাবে।
বর্তমান দাওয়াতে তাবলিগের দ্বারা সবচেয়ে বড় যে উপকারটি হচ্ছে তা হলো, এর দ্বারা সব পেশা, শ্রেণী, বয়সের মানুষের সমাবেশ ঘটানো। দাওয়াতে তাবলিগের মাধ্যমে একজন বয়স্ক লোকও দ্বীন শিখতে পারেন। একজন অতি উঁচু পর্যায়ের শিক্ষিত, যিনি দ্বীন সম্পর্কে কোনো জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাননি তাকেও এর মাধ্যমে দ্বীনের জ্ঞান দান করা যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যে জনবহুল দেশ, এই দেশে সব মানুষকে দ্বীনের পথে আনার, এর চেয়ে উত্তম পথ আর কী আছে? দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কতজন লোককে দ্বীনের জ্ঞান দান করা সম্ভব? আজকে দাওয়াতে তাবলিগের সঙ্গে সব দল সমর্থন দিচ্ছে, সময় দিচ্ছে, সুযোগ হলেই তারা ছুটে আসছে বিশ্ব ইজতেমায়, তিনদিনে, একচিল্লায় বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আল্লাহর রাস্তায়। এ পথ কে বের করে দিয়েছে? এই তাবলিগের মাধ্যমেই তো সম্ভব হয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা দাওয়াতের এক বিরাট সুযোগ। এর মাধ্যমে অনেক কিছু শেখার আছে। ইজতেমা উপলক্ষে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে মুসলমানরা আসছেন, তাদের দেখে, তাদের সঙ্গে মিশে আমরা যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একটি সম্প্রদায়ের অংশ তা কি উপলব্ধি করতে পারছি না? বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা লোকগুলো আমাদের আতিথেয়তা লাভ করে তাদের দেশে গিয়ে আমাদের দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। বিশ্ব পরিচিতির ক্ষেত্রে এ এক বিরাট সুযোগ। বিশ্ব ইজতেমা আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশ ও জাতির পরিচয় বিশ্বের দরবারে অনেক উঁচু করে তুলে ধরছে। বিশ্ব ইজতেমা আমাদের গৌরবের একটি অংশ হয়ে গেছে। মানুষের কল্যাণে, হেদায়েতের আলোকবর্তিকা বিস্তারে এর চেয়ে উন্নত বিকল্প এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। বিশ্ব ইজতেমাকে আরও সুন্দর, আরও সফল করার জন্য আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের সবার সর্বোচ্চ সামর্থ্যটুকু উজাড় করে দিয়ে বিশ্ব ইজতেমাকে সফল করতে হবে। বিদেশ থেকে যারা আসছেন তাদের সামনে ইতিবাচক বাংলাদেশ তুলে ধরতে হবে। তারা আমাদের দেশে প্রতিটি দেশের একেকজন রাষ্ট্রদূত। আজকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে নেতিবাচক, ষড়যন্ত্রমূলক কথা ছড়ানো হচ্ছে তা দূর করার অন্যতম একটি পথ হতে পারে এই বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে আমাদের দেশে মুসলমান ভাইয়েরা আসেন, তাদের মেহমানদারি, রাস্তাঘাটে তাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার মন নিয়ে আমরা বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করব। এর মাধ্যমে দেশের প্রভূত কল্যাণ হবে।
alhuda_wf@yahoo.com
No comments:
Post a Comment