আমার দেশ থেকে সংগ্রহিত :
৫০তম বিশ্ব ইজতেমার ১ম অংশ ২০১৩ সালের ১১, ১২, ১৩ জানুয়ারি এবং ২য় অংশ ১৮, ১৯, ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। বিশাল এ জনসমাবেশ সম্পর্কে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষসহ সারা দুনিয়ার মুসলিম সমাজের আগ্রহের কমতি নেই। মিডিয়ার কল্যাণে এখন এ সমাবেশের কথা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হচ্ছে। তাবলিগ জামাতের এ সমাবেশ ছোট আকারে শুরু হয়েছিল ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। কেন্দ্রস্থল কাকরাইল মসজিদ, তবে বার্ষিক সমাবেশের স্থান গড়ে উঠেছে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরের বিশাল প্রান্তরে। তাবলিগ জামাতের বার্ষিক বিশ্ব ইজতেমা নিয়মিতভাবে টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত হলেও তাবলিগের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ভারতের রাজস্থান রাজ্যের মেওয়াত নামক এলাকা থেকে। মাওলানা ইলিয়াছ (রহ.) ১৯১০ সালে এ কাজের সূচনা করেছিলেন। পরে তাঁর পুত্র মাওলানা ইউসুফ (রহ.) এবং মাওলানা জাকারিয়া (র.)-এর নেতৃত্বে এ কাজ বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত হয়েছে। তাবলিগ মূলত প্রচারের কাজ। দীনের দাওয়াত নিয়ে সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে, বিশেষ করে মুসলিম সমাজের ঘরে ঘরে পৌঁছানোই আল্লাহর রাহে তাঁদের নিঃস্বার্থ কাজ। তবে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁরা ভাবাদর্শিকভাবে প্রচারবিমুখ। নীতিনির্ধারক বা নেতৃত্ব পর্যায়ের লোকদের তারা মুরব্বি বলেন। তাবলিগের মুরব্বি কে বা কারা সেটা কোনো গোপন বিষয় নয়। জোরালো অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় চলে তাঁদের সংগঠন, নীতিনির্ধারণ ও নেতৃত্ব দানের কাজ। কিন্তু কে নেতা আর কে কর্মী, কার কী অবদান, কার গুরুত্ব কতখানি, কে আগে, কে পরে, কার নাম প্রকাশ পেয়েছে, কার নাম প্রকাশ পায়নি—এসব বিষয়ে তারা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে নির্মোহ ও নির্লিপ্ত।
আধুনিককালের এই প্রচারসর্বস্বতার জোয়ারের ভেতর তাঁদের এই ভাবাদর্শিক অবস্থানটিও যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ। তাবলিগ জামাত যতদিন তাদের এই ভাবাদর্শিক অবস্থানটি আন্তরিকভাবে ধরে রাখতে পারবে, ততদিন মানুষের শ্রদ্ধার স্থল হয়ে থাকবে নিশ্চয়। তাবলিগ শব্দটির অর্থ হচ্ছে পৌঁছে দেয়া। ইসলামের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াই এ কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য।
ইসলামের আদেশ-নিষেধ ও ধর্মীয় শিক্ষাকে শুধু বই পুস্তক পড়া বা ওয়াজ-নসিহত শোনার মাধ্যমে নয়; বরং বাস্তব জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার একটি পদ্ধতি। এর অন্যতম প্রধান সাংগঠনিক কাজ হচ্ছে ‘চিল্লা’। অর্থাত্ ৪০ দিনের জন্য জামাতবদ্ধ হয়ে তাবলিগের কাজে বের হয়ে যাওয়া। আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া এই দল ইসলামের শিক্ষা দাওয়াত নিয়ে চলে যায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহর থেকে শহরান্তরে এবং দেশ থেকে দেশান্তরে। ৪০ দিনের জন্য বা তিন চিল্লায় ১২০ দিনের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে যান; কিন্তু তাঁরা বনে যান না বা আত্মগত তপস্যায় নিমগ্ন হন না। তাঁরা যান লোকালয়ে সমাজের ভেতরে। সেখানে তাঁরা শুধু মানুষকে শেখাতে যান না, নিজেরা শিখতে যান।
তাবলিগের চিল্লায় যেতে হয় নিজের পয়সা নিয়ে, বিপদাপদে ধারদেনা পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু কোনো দান-খয়রাত গ্রহণ করার সুযোগ নেই। অপরদিকে যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে যাওয়া হবে তাঁদের কোনো দান- খয়রাত দেয়ার অনুমতি নেই।
আত্মনিবেদনের মাধ্যমে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণের জন্য সমাজের ভেতরে বিচরণ, এটা তাবলিগের এক মহান শিক্ষা। এ শিক্ষাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে মানব সমাজের জন্য তাবলিগ নিঃসন্দেহে মহত্ ভূমিকা পালন করবে।
এক অন্যরকম আয়োজন
ইজতেমার পরিধি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে তা হচ্ছে এর গ্রহণযোগ্যতা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, চেতনা সহনশীলতা, কর্মসূচি সর্বজনীনতা ও সাংগঠনিক কৌশল। ইজতেমা মূলত একটি ধর্মীয় সমাবেশ এবং একটি নির্দলীয়, অর্থাত্ অরাজনৈতিক দলের বার্ষিক সম্মেলন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ সম্মেলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে একে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এতবড় একটি মহাসমাবেশ, অথচ এর জন্য নেই কোনো অর্থ সংস্থান। অর্ধকোটি মানুষের চার-পাঁচদিন থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক কাজ—সব মিলিয়ে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা। কিন্তু এ নিয়ে আয়োজকদেরও নেই তেমন কোনো টেনশন। সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে, কোনো ফান্ড ছাড়াই স্বেচ্ছাশ্রমে এবং স্বপ্রণোদিত দানের ভিত্তিতে কি করে হচ্ছে সবকিছু! ১৬০ একর এলাকা জুড়ে যে বিশাল ছাউনি তৈরি হয় তিন মাস ধরে, তাতে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করতে হয় না। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব বয়সের লোক মাঠের কাজে যোগ দেয়। পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া এমন ছাত্রও রয়েছে যে শিশুটি বাসায় এক গ্লাস পানি নিজে জগ থেকে নিতে চায় না, সে শিশুটি ইজতেমা মাঠে বাবার সঙ্গে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। কাঁধে বাঁশ নিয়ে হাসিমুখে হেঁটে যাচ্ছে। ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের বাথরুম তৈরিতে যাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
প্রতি বছর ইজতেমায় আসেন পাঁচ-সাত হাজার বিদেশি মেহমান। এবার আসলেন প্রায় ২০-২৫ হাজার। তাঁদের একেকজনের খাবার একেক রকম। আরবীয়রা যা খান, ইংরেজরা তা খান না। তাঁদের রুচি ও ইচ্ছার প্রতি লক্ষ্য রেখে ইজতেমায় রান্না হয় হরেক রকম খাবার। এসব খাবার জোগান দিতে কোনো সমস্যাই হয় না। তাবলিগের অনেক মুসল্লি আছেন, যাঁরা বিদেশি মেহমানদের খেদমতের (বিদেশি মেহমানদের নছরতের জন্য) অপেক্ষায় থাকেন সারা বছর। বিদেশিরা এ দেশের মেহমানদারিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গী পরিণত হয় ধর্মীয় উত্সবের নগরীতে। প্রতিটি বাসা-বাড়ি, কারখানার শ্রমিক, কলোনি—সবখানেই অতিথির আগমন ঘটে। ইজতেমায় কয়েকদিন এখানকার সবাইকে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকতে হয়। যাঁরা জামাতবদ্ধ হয়ে আসেন, শুধু তাঁদের জন্যই নির্ধারিত খেত্তায় স্থান বরাদ্দ রাখা হয়। তিনদিন কষ্ট সহ্য করে ধর্মের কথা শুনতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে এখানে বসে থাকেন ছোট বালক থেকে বৃদ্ধরা। স্বউত্সাহে দ্বীনি জজবায় উজ্জীবিত হয়ে ছামানাপত্রসহ চলে আসেন ইজতেমায়। ষাটোর্ধ্ব এক প্রবীণ জানালেন, তাবলিগ জামাতের আধ্যাত্মিকতার বেশ চমকপদ কাহিনী। তিনি ৩০ বছর ধরে তাবলিগের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, জীবন যৌবন সব কিছুই আল্লাহর দেয়া। আমার বলতে কিছুই নেই, বউ-বাচ্চা সবই আল্লাহর। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার ২নং ইউনিয়ন জিম্মাদার জনাব আবদুর রাজ্জাক বলেন, জানা আল্লার দেয়া; আল্লার দেয়া মাল নিয়ে তারই রাস্তায় বের হয়েছি এতে কষ্ট কি? নবীজি এক টুকরো খেজুর খেয়ে রাতের পর রাত দিনের পর দিন অতিবাহিত করে তৌহিদের (দ্বীনের) দাওয়াত দিয়ে গেছেন। আর আমরা তো সেই নবীর উম্মত। জান্নাতে চিরস্থায়ী সুখী হওয়ার জন্য ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়াতে আমরা কিছুটা কষ্ট করতে পারি না? এক প্রশ্নের জবাবে আবদুর রাজ্জাক জানান, এই কাজ (তাবলীগের দাওয়াত) বড় উঁচু কাজ। এই কাজ করে গেছেন নবী-রাসুলরা। দুনিয়ার সব মানুষই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, শুধু তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি, তার নবীর প্রতি এবং যারা সত্কর্ম করে। তিনি বলেন, তাবলীগের কাজে সময় ব্যয় করতে করতে আল্লাহর রাস্তায় থেকেই যেন আমার মৃত্যু হয়। কারণ, আল্লাহর পথে দ্বীনের দাওয়াত অবস্থায় মৃত্যু হলে এটা হবে সৌভাগ্যের, ঈমানী মৃত্যু, ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের চোখে-মুখে থাকে না কোনো বিরক্তি, নেই কোনো হতাশা অথবা আয়োজকদের প্রতি কোনো অভিযোগ।
সবার মুখে আল্লাহ আল্লাহ জিকির। শাখা সড়কের পাশে স্বেচ্ছাসেবকরা দাঁড়িয়ে শুধু বলেন, ‘যার যার ডাইনে চলি ভাই, জিকিরে জিকিরে চলি ভাই’।
দেশ-বিদেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের আগমন ঘটে। কিন্তু কেউ নিজের পরিচয়টুকু প্রকাশ করেন না। মন্ত্রী, এমপি সবাই সমান। তাঁরা বয়ান করেন শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁদের বয়ানে কাউকে কটাক্ষ করে কিছু বলা, কাউকে প্রশংসা করে কিছু বলার সুযোগ নেই।
শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য
তাবলিগ আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো রাসুলের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। এখানে সুন্নাহ পালনের জন্য কোনো জবরদস্তি করা যায় না। বরং নবীর জীবনচরিত নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করে তাঁর প্রতি বিশেষ মহব্বত সৃষ্টি করা হয় তাবলিগে। যাঁরা তাবলিগ করেন, তাঁরা তাবলিগ থেকে ফিরে এসে রাজনীতি করতে পারেন। কিন্তু তাবলিগে গিয়ে রাজনীতি করা নিষিদ্ধ। তাই সব দলের অনুসারীরা তাবলিগে অংশ নেন। ইসলাম ধর্মে নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা ফেরাউন-নমরুদের প্রকৃতি।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দেখা গেছে, নেতৃত্ব নিয়ে তাবলিগের কোনো সঙ্কট নেই। তাবলিগের সাফল্য নেতার ওপর নির্ভরও করে না। নেতা দুর্বল বা অসুস্থ হলেও তাবলিগের কাজে ব্যাঘাত হয় না। এটি একটি সুশৃঙ্খল আন্দোলন বিধায় অনুসারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো শাস্তি বা সমালোচনা নেই। এ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় সেবা, সম্মান এবং ভালোবাসার মাধ্যমে। আমিরের অনুমতি ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারেন না। কিন্তু কেউ তা লঙ্ঘন করলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না। লঙ্ঘনকারীর অন্তরকে পরিবর্তন করা হয় আলোচনা, সম্মান ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে।
তাবলিগে যারা নতুন যোগ দেন তাঁদের প্রথমই বলে দেয়া হয়, দুনিয়ায় তাবলিগের কাজের পরিধি হলো—জমিনের নিচে এবং আসমানের ওপরে। আসমানের ওপরওয়ালার সন্তোষ হাসিল করে জমিনের নিচের জিন্দেগি অর্থাত্ মৃত্যুর পরের জিন্দেগিকে সুন্দর করাই এর মূল লক্ষ্য। তাবলিগের মুরব্বিরা সাফল্যের জন্য সব সময় আল্লাহর ওপর নির্ভর করেন এবং তাঁর সাহায্য কামনা করেন। তাবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের আমলের পুরস্কার একমাত্র আল্লাহতায়ালার কাছে কামনা করেন।
তাবলিগ জামাত ও বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাস
১৯১০ সালে ভারতবর্ষের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুসলিহে মিল্লাত মাওলানা ইলিয়াছ কান্ধলভী (রহ.) তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন রাজস্থানের মেওয়াত নামক এলাকা থেকে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজেই এ কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায়ই এ মহত্ কার্যক্রম ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াছের (রহ.) মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভীও এ কার্যক্রমের প্রাণপুরুষ ছিলেন। মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) পরবর্তী সময়ে তাবলিগ জামাতের অন্যতম আমির বা নেতা ছিলেন। বাংলাদেশে তাবলীগ জমাতের আজীবন আমির ছিলেন মাওলানা আব্দুল আজিজ (রহ.)। তিন-চার দশকের মধ্যেই তাবলিগের কার্যক্রম সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তার লাভ করে এবং ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার কাকরাইল মসজিদে ১৯৪৬ সালে প্রথম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। কাকরাইল মসজিদকে তাবলিগের মারকাজ মসজিদ বলা হয়। ১৯৪৮ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৬৫ সালে টঙ্গীর পাগার নামক স্থানে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও জায়গা সঙ্কুলান না হলে ১৯৬৭ সাল থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদীর পূর্ব তীর অর্থাত্ বর্তমান স্থানে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর উপকণ্ঠে শিল্প শহর টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত তিনদিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার সফল সমাপ্তি ঘটে। বিশ্ব ইজতেমা এবং দেশের সর্ববৃহত্ ধর্মীয় সমাবেশস্থলে পরিণত হয়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার টঙ্গীর ইজতেমা স্থলের জন্য সরকারি জমি প্রদান করেন। ১৯৯৬ সালে তত্কালীন সরকার এ জায়গায় ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়।
তাবলিগে বাহ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় খাস নিয়তের উপর। চিল্লা হচ্ছে তাবলিগ কার্যক্রমকে সংগঠনবদ্ধ বা শৃঙ্খলাবদ্ধ করার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বছরে একচিল্লা এবং জীবনে অন্তত তিন চিল্লা দেয়ার জন্য সাধারণভাবে সব মানুষকে অনুপ্রাণিত করা হয়। যারা আপাতত চিল্লায় যেতে পারছেন না, তাদের জন্য এক সপ্তাহ, তিনদিন বা একদিন আল্লাহর রাহে দাওয়াতের কাজে ব্যয় করারও ব্যবস্থা আছে।
জিকির ও ফিকিরের সঙ্গে চলা : জিকির মানে হচ্ছে আল্লাহকে সর্বক্ষণ স্মরণে রাখা। জিকিরের তাত্পর্য হচ্ছে আল্লাহর প্রতি জবাবদিহিতার মনোভাব জাগ্রত রাখা। আর ফিকির হচ্ছে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। তাবলিগ মানুষকে উদাসীনতা পরিহার করে জিকির ও ফিকিরের সঙ্গে চলার শিক্ষা দেয়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ইজতেমা মঞ্চে প্রায় দেড় শতাধিক যৌতুকবিহীন বিয়ে পড়ানো হয়।
ছয় উসুল (ছয়টি বুনিয়াদি শিক্ষা) : ১. কালেমা বা ঈমান ২. নামাজ ৩. ইলম বা জ্ঞান ৪. ইকরামুল মুসলেমিন বা মানুষকে সমীহ করা ৫. তাসহিহে নিয়ত ও ৬. তাবলিগ।
এই ছয় অসুল কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের বিকল্প নয় বা এর মধ্যে কোনো বিতর্কও সৃষ্টি করা হয় না। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক শিক্ষাগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে প্রতিফলিত করার লক্ষ্যে সহজবোধ্য করে তোলার জন্য এই ছয় উসুলে বিধিবদ্ধ শিক্ষা প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, তাবলিগ কার্যক্রমের সূচনা হয়েছিল ১৯১০ সালে। ২০১০ সালে পদার্পণের মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রমের শত বছর পূর্ণ হলো।
সারা বছর সব শ্রেণীর ধর্মপ্রাণ ও তাবলীগভক্ত মানুষ নিজ খরচে এ মেহনত ও দ্বীনের কাজে সময় দিয়ে থাকেন। তাবলীগের ছোট ছোট ইজতেমা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। গত বছর ইজতেমার খেত্তা ছিল ৩২টি। এ বছর আরও অধিকসংখ্যক মুসল্লি সমাগমের আশঙ্কায় ইজতেমা ময়দানে ৩৩ খেত্তায় উন্নীত করা হয়। পুরো মাঠে ৫শ’টি শব্দ প্রতিধ্বনি রোধক বিশেষ ছাতা, মাইক স্থাপন করা হয়েছে। পুরো ময়দান জুড়ে তৈরি করা হয়েছিল ২১০টি মুকাব্বির মঞ্চ। বিদ্যুত্ সরবরাহের জন্য দ্বিমুখী সংযোগ লাইন স্থাপন ছাড়াও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি জেনারেটর প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এবারও র্যাবের ৬টি ও পুলিশের ৩টি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের নিরাপত্তার স্বার্থে ৩৩টি খিত্তায় মুসল্লিবেশে দু’জন করে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য নিয়োজিত থাকার কথা জানা গেছে। ইজতেমা ময়দান ও তার ১৮টি প্রবেশদ্বারসহ গুুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ৬০টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়।
তাবলিগের প্রাণপুরুষ মানব দরদি মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ (রহ.)-এর জন্ম ১৩০৩ হিজরি মোতাবেক ১৮৮৪ সালে। তার বংশধররা ছিলেন দিল্লির ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের অগ্র সেনানি। ১৩২৬ হিজরিতে তিনি দাওরায়ে হাদিস বা হাদিস শাস্ত্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবন শুরু হয় ১৩২৮ হিজরিতে, সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। একাধারে প্রায় আট বছর তিনি দীনের ইলম বিতরণে কাজ করেন। পিতা ও ভাইয়ের ইন্তেকালের পর মেওয়াতবাসী তাকে অনুরোধ জানান—তিনি যেন মেয়াতে ফিরে যান। মানুষের কল্যাণ সাধনই ছিল তার জীবনের মহান ব্রত।
No comments:
Post a Comment