দাওয়াত, তাবলিগ ও আধুনিক প্রযুক্তি
মুফতি জহীর ইবনে মুসলিম
দাওয়াত ও তাবলিগ ইসলামের অন্যতম কর্মসূচি। এই দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটে। মুসলিম উম্মাহ লাভ করে বিস্তৃতি। নির্মিত হয় ইসলামী সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি। ইসলামকে বিজয়ী সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে দাওয়াত ও তাবলিগের কোনো বিকল্প নেই। ইসলাম দাওয়াত ও তাবলিগ অনুশীলনের প্রেরণা জোগায়, ইসলাম কায়েমের পথ করে সুগম। তাবলিগ ও দাওয়াতের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের আঁধার কেটে সত্য ও ন্যায়ের সোনালি সূর্যের উদয় ঘটে। দাওয়াত ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ তুলে ধরে। দাওয়াত মানে সত্য অনুশীলনের দিকে ডাকা। দাওয়াত মানবতার মুক্তির কথা বলে, কল্যাণের কথা বলে। ইহকাল ও পরকালের সার্বিক কল্যাণের দিকে ডাকাই হলো দাওয়াত। তাবলিগ জামাতের প্রাণপুরুষ হজরতজি ইউসুফ (রহ.) দাওয়াত ও তাবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, ইমান সম্পর্কে বোঝানোর নাম দাওয়াত আর আমল সম্পর্কে বোঝানোর নাম তাবলিগ। দাওয়াত ছাড়া তাবলিগ করলে কোনো লাভ হবে না; বরং বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে হুজুর (সা.) এক যুগে কেবল দাওয়াত দিয়েছেন কিন্তু তাবলিগ করেননি। তারপর তিনি বলেছেন, দাওয়াতের উপাদান প্রধানত ১০টি। যথা_আল্লাহর বড়ত্ব, আল্লাহর কুদরত, আল্লাহর বিশালত্ব, মৃত্যু, কবর, হাশর, মিজান, পুলসিরাত, জান্নাত ও জাহান্নাম (হজরতজির স্মরণীয় বয়ান)।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী আল্লামা ইবনে খালদুন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'মুকাদ্দামায়ে ইবনে খালদুন'-এ লিখেছেন, বস্তুত কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠী তিনভাবে বিস্তৃতি লাভ করে_এক. স্থানান্তর বা মাইগ্রেশনের মাধ্যমে; দুই. জন্ম ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে এবং তিন. ধর্মান্তরের মাধ্যমে। মুসলিম উম্মাহর বিস্তৃতি ও সম্প্রসারণ এই তিন উপায়ে হচ্ছে। যাওয়াত ও তাবলিগ এই বিস্তৃতি ও সম্প্রসারণের প্রক্রিয়াকে সুগম ও সুন্দর করে। দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে সব জাতিতে, সব বর্ণে, সব দেশ ও অঞ্চলে ইসলামের চিরসুন্দর ও আদর্শমণ্ডিত বাণী পেঁৗছে যেতে পারে। ইসলাম দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে সর্বত্র তার অবস্থান করে নিতে পারে। অতীতে তা-ই হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে। ইসলাম শূন্য থেকে শুরু হয়েছে, কিন্তু দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে তা আজ মহীরুহের রূপ ধারণ করেছে। দাওয়াত ও তাবলিগের ব্যাপকতা বাড়ালে উম্মাহর অভ্যন্তরীণ সংহতি ও বাইরের সম্প্রসারণ দ্রুত সম্ভব। একক সভ্যতা হিসেবে ইসলামের উত্থান ঘটাতে হলে উম্মাহকে আরো সম্প্রসারণ করতে হবে। আর এ জন্য দাওয়াত ও তাবলিগের কোনো বিকল্প নেই। বলতে গেলে দাওয়াত, তাবলিগ ও ইসলামের সম্প্রসারণ, বিস্তৃতি এক সূত্রে গাঁথা।
আমাদের অনেকেরই ধারণা, বিশেষ পদ্ধতিতে দাওয়াত দেওয়াই কেবল তাবলিগ। এই বিশেষ পদ্ধতিই একমাত্র সুন্নাহ স্বীকৃত। কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশেষভাবে দাওয়াত দেওয়াই কেবল রাসুল (সা.)-এর তরিকা, অন্য কোনো পন্থায় দাওয়াত দেওয়া, তাবলিগ করা স্বীকৃত নয় বলে কারো কারো ধারণা। কিন্তু রাসুলে করিম (সা.)-এর বাস্তব কাজ তা বলে না। নবুওয়াতপ্রাপ্তির প্রথম তিন বছর তিনি প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, আবার যখন প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়ার পরিবেশ হলো, তখন তিনি প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। আল্লাহ তায়ালা যখন নির্দেশ দিলেন, 'তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করো আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুগত, তাদের জন্য তুমি তোমার পক্ষপুট অবনমিত করো' (সুরা সুয়ারা, আয়াত ২১৪-১৫), তখন রাসুল (সা.) হজরত আলী (রা.)-এর মাধ্যমে আত্মীয়স্বজনের সম্মানে এক ভোজসভার আয়োজন করেন। তাতে তাঁর নিকটাত্মীয়দের প্রায় ৪০ জন উপস্থিত হন। ভোজের পর তিনি মেহমানদের সামনে সত্যের দাওয়াত পেশ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু আবু লাহাবের চক্রান্তে দাওয়াতদানের পরিবেশ বিনষ্ট হয়। ফলে সেদিন তিনি দাওয়াত দিতে পারলেন না। পরে তিনি আরেকটি ভোজসভার আয়োজন করেন এবং সেখানে আবু লাহাবকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ত্বরিত তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। তাঁর দাওয়াত তুলে ধরেন আমন্ত্রিত মেহমানদের সামনে ('আল বিদায়া ওয়ান্ নিহায়া', তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫)। এখানে মূলত দাওয়াতদানের জন্য ভোজসভার মতো একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের তিনি ব্যবস্থা করেন। ভোজসভা ছিল উপলক্ষ, লক্ষ্য ছিল দাওয়াত ও তাবলিগ।
প্রকাশ্যে ও জনসমক্ষে তাঁর দাওয়াত পেশ করার জন্য তিনি তৎকালীন মক্কায় প্রচলিত একটি পদ্ধতি কাজে লাগান। সে সময় মক্কায় নিয়ম ছিল, কোনো শত্রু সম্পর্কে সতর্ক বা কোনো বিপদ-আপদ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মক্কাবাসীকে অবহিত করার জন্য সাফা পর্বতে আরোহণ করে মক্কাবাসীকে আহ্বান করতে হতো। নবীয়ে করিম (সা.) তাঁর দাওয়াত বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে পেশ করার জন্য এ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন ('আল বিদায়া ওয়ান্ নিহায়া')।
ঠিক এমনিভাবে মহানবী (সা.) ওকাজ মেলার সমাবেশ, হজের মৌসুমকেও তিনি দাওয়াতদানের জন্য কাজে লাগান। পরে তিনি পত্রের মাধ্যমে সে সময়ের রাজা-বাদশাহ ও রাজন্যবর্গকে ইসলামের দাওয়াত দেন। দাওয়াতসংবলিত পত্র দিয়ে তিনি বিভিন্ন দেশে দূত পাঠান। বস্তুত সমকালীন যুগের সব বৈধ ও নির্দোষ পদ্ধতিই তিনি তাঁর দাওয়াত ও তাবলিগের জন্য ব্যবহার করেন। যখন যে পদ্ধতি কার্যকর, উপযুক্ত ও ফলপ্রসূ বিবেচিত হয়েছে, তখন সে পদ্ধতিই তিনি অবলম্বন করেছেন। আজকের যুগেও দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য, সত্য তুলে ধরার জন্য প্রচলিত সব বৈধ পদ্ধতি ও উপায়-উপকরণ ব্যবহার করা দরকার। একক যোগাযোগ, সভা-সমাবেশ, ধর্মীয় জ্ঞান, পাঠদান, লেখনী, বক্তৃতা, পত্রপত্রিকা, রেডিও, কম্পিউটার প্রযুক্তি_সবই দাওয়াত ও তাবলিগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা প্রয়োজন।
এসব পদ্ধতিতে কোনো একটার মাধ্যমে যাঁরাই দ্বীনের কথা বলছেন, ইসলামের প্রচার-প্রসারের চেষ্টা করছেন, তাঁরা সবাই দাওয়াত ও তাবলিগ করছেন।
দাওয়াতি কর্মসূচি ও কাজকর্মে সমকালীন অবস্থার প্রতিফলন ঘটতে হবে। হজরত নবী করিম (সা.)-এর দাওয়াতি কর্ম ও বক্তব্য থেকে তা-ই বোঝা যায়। নানা সংকটের আবর্তে বর্তমান মুসলিম বিশ্ব, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, বহু ক্ষেত্রে সংকট প্রলম্বিত। এসব সংকট ও সমসাময়িক ইস্যুগুলো এড়িয়ে গেলে আমরা মনে করি দাওয়াতের পূর্ণতা আসবে না। ধর্মীয় সচেতনতাসহ নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি দাওয়াতের লক্ষ্য। বর্তমান মুসলিম উম্মাহর জাগরণে ও সংকট উত্তরণে দাওয়াত ও তাবলিগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের পথ হতে পারে সুগম। আজকের মুসলমান বিশ্বের সংকটময় পরিস্থিতি ও সাম্রাজ্যবাদের পরিপ্রেক্ষিতে গোটা মানবতার, বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর মুক্তির লক্ষ্যে আমাদের দাওয়াত ও তাবলিগের কর্মসূচিকে আরো জোরদার করতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।
No comments:
Post a Comment