Sunday, 26 August 2012

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদগণের সাক্ষাৎকার



জানুয়ারি ২৮,২০১১, শুক্রবার: ১৫ মাঘ,১৪১৭।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদগণের সাক্ষাৎকার

বিশ্ব ইজতেমা দাওয়াতী তৎপরতার ফসল

আমাদের ইসলাম ধর্মে অসংখ্য নবী ও রসুল এসেছেন। তারা সকলেই নিজ নিজ কওমের কাছে একত্ববাদের দাওয়াত দিয়ে গেছেন। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) কে আলস্নাহ তায়লা পৃথিবী বাসীর জন্য রসূল করে পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সমগ্র আরব ভূ-খন্ডে ইসলামের আলো প্রজ্জলিত করে গিয়েছিলেন। এরপর তাঁর খোলাফায়ে রাশেদীনের মাধ্যমে অর্ধ-পৃথিবীতে ও তার পর তাবাতাবেঈন ওলি আওলিয়াদের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামের কালজয়ী আদর্শের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলাম তরবারীতে নয় উদারতায় এসেছিল। যেহেতু মুহাম্মদ (স.) সবৃশেষ নবী ও তাঁর পর আর কোনো নবী পৃথিবীতে আসবে না। সেহেতু দাওয়াতের এই গুরু দায়িত্ব সকল ইমানদার মুসলমানদের ওপর বর্তায়। সে হিসাবে তাবলীগ জামায়াত সংক্ষিপ্তরূপে হলেও ইসলামের দাওয়াতকে মানুষের কাছে পেঁৗছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশ্ব ইজতেমা তারই ফসল। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ও বিদেশ হতেও লক্ষ লক্ষ মানুষ টঙ্গির তুরাগ নদীর তীরে জড়ো হচ্ছে ঈমান ও আমলের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তারা মানুষকে ভাল বাসছে। মায়া মমতা শিক্ষা দিচ্ছে। মানব সেবা মূলক কাজ করছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি তারা যদি ইজতেমা হতে নিজ নিজ গৃহে ফিরে গিয়ে নিরক্ষর মানুষকে স্বাক্ষরতা দান করতেন তাহলে সরকারের স্বাক্ষরতা অভিযান শতভাগ সফল হিসেবে প্রতিপন্ন হতো। এদেশে কোনো নিরক্ষর মানুষ থাকতো না। আর এ ব্যাপারে কুরআন হাদীসেও বলা হয়েছে- সেই সেরা মানুষ যে মানুষ জ্ঞান শিক্ষা দেয়। সুরা ইমরানের ১০৪নং আয়াতে বলা হয়েছে- তোমাদের মধ্যে একটি দল অবশ্যই থাকবে যারা ভাল কাজের আদেশ দিবে ও মন্দ কাজের নিষেধ করবে। এই দু'টি গুণ অবশ্যই তাবলীগ জামায়াতের মধ্যে পরিস্ফুটিত করতে হবে। বিশ্ব ইজতেমা সফল হোক সেই কামনা করছি।

প্রফেসর ড: মো: শমসের আলী

ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানী

ভাইস চ্যান্সেলর সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।



বিশ্ব ইজতেমা দাওয়াতী কাজে গতি সঞ্চার করে

বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে তাবলীগ জামায়াতের দাওয়াতী কাজে গতি সঞ্চারিত হয়। দেশ বিদেশের নানা ভাষায় নানা রঙের মানুষের মিলন হওয়ায় নিজের মধ্যে জড়তা বিদূরিত হয়। প্রচার ছাড়া কোনো কিছুই প্রসারিত হয় না। ইসলামের প্রচার না থাকলে এটাও এক সময় সংকুচিত হয়ে যাবে। সে কারণে মুসলামনদের মধ্যে একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে যারা তাবলীগের কাজে নিয়োজিত থাকবে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে অসংখ্য জায়গায় এ সমস্ত কথা বারবার আলোকপাত করা হয়েছে। সর্বশেষ বিদায় হজের ভাষণে রসুল (স.) বলেন "ফাল ইউবালিস্নগুশ শাহিদী ওয়াল গাইব" অর্থাৎ তোমাদের উপস্থিত ব্যক্তিরা অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে আমার কথাগুলি পেঁৗছে দেবে। অন্য হাদীছে বলা হয়েছে তোমরা যদি আমার পক্ষ থেকে একটি কথাও জানো তাহলে তা মানুষের কাছে পেঁৗছে দাও। এ দায়িত্ব প্রত্যেক মুসলমানদের ওপর তাবলীগ জামায়াত সীমিতরূপে হলেও ইসলামের দাওয়াতী কাজে ভূমিকা রাখছে। বিশ্ব ইজতেমা তারই প্রতিফলন। বিশ্ব ইজতেমা সফল হোক ও ইজতেমা শেষে সবার বাড়ী ফেরা সহজ ও সাবলীল হোক সেই প্রত্যাশা করছি।

প্রফেসর ড. আ,ন,ম, রইছ উদ্দিন

সাবেক চেয়ারম্যান

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



মুসলিম বিশ্বে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে বিশ্ব ইজতেমা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় সারা বিশ্বের মুসলমানদের ইসলামের সুমহান পতাকাতলে নিয়ে আসার জন্য বিশ্ব মুসলিমের এই সম্মেলন এক অনবদ্য ভূমিকা রাখতে ইতিমধ্যেই সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমার মতো একটি বৃহৎ সম্মেলন বাংলাদেশের এই ছোট্ট ভূখন্ডে অনুষ্ঠিত হওয়ায় আমি একজন বাঙ্গালী মুসলমান হয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করি। দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল তাদের মতপার্থক্য ভুলে কুরআন এবং হাদীসের অমিয় বাণী শুনার জন্য এই সম্মেলনে উপস্থিত হয়। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় যে, আমাদের দেশের সর্বস্তরের কতিপয় মানুষ এই সম্মেলন শেষ হওয়ার পরে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন তাদের অনেকেই দুনিয়াবী স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পুনরায় গোমরাহীর দিকে পা বাড়ায়। তবে ইসলাম প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে বিশ্ব ইজতেমা সারা বিশ্বের বুকে মডেল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমাদের বিশ্বাস, একদিন পৃথিবীর মানুষ বিশ্ব ইজতেমার কল্যাণে সমস্ত হিংসা বিদ্বেষ ভুলে আবার একত্রিত হয়ে তাদের সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে যাবে। সারা বিশ্বে ফিরে আসবে শান্তির অমিয় ধারা । বিশ্ব ইজতেমা সফল হোক সার্থক হোক এটাই আমাদের সকলের কাম্য। আলস্নাহ হাফেজ ।।

আমাদের সমাজের বহু মানুষ আছে যাদের অনেকেই ছিল অসৎ, বেনামাজী, ঘুষখোর, এছাড়া সকলপ্রকার অন্যায় অপকর্ম ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল যাদের নিত্যসঙ্গী ঠিক এরকম হাজারো সমাজের বিষফোঁড়া ইজতেমার ওসিলায় আদর্শ সুনাগরিক হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের চারপাশে একটু নজর দিলে এর বহু প্রমাণ পাওয়া যাবে।

আপনাকে ও দৈনিক ইত্তেফাকের সকল পাঠককে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।

প্রফেসর ড. আব্দুস সালাম আল মাদানী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের শিক্ষক, দেশবরেণ্য বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ

তাবলীগের বিশ্ব ইজতেমা একটি অরাজনৈতিক নিছক ধমর্ীয় সমাবেশ, যেখানে আগতদের মাঝে ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটানো এবং বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে নিজের ধমর্ীয় দিকের উন্নয়নের সাথে সাথে দাওয়াতের মাধ্যমে অন্যের মধ্যে ধমর্ীয় চেতনা জাগ্রত করার এক মহান প্রয়াস চালানো হয় এ ইজতেমায়। আর এসব কিছু করা হয় একান্ত নিঃস্বার্থভাবে-ইখলাসের সাথে কেবল আলস্নাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে, নিজের উপর আলস্নাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালনার্থে। সুতরাং এ ইজতেমা মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত বিধায় আমি এর সাফল্য কামনা করি।

বিশ্ব ইজতেমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আমার জানামতে, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল হতে আগত ত্যাগী মানুষগুলোর মাধ্যমে ইসলামের সুমহান ও তার বিশ্বভ্রাতৃত্বের রূপরেখা বাস্তব আসলের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা। ইসলাম সমগ্র মানবতার মুক্তির জন্য বিধায় ইসলাম বিশ্বধর্ম, নবী বিশ্বনবী, আলস্নাহ সকল মাখলুকাতের , আর তার উদ্দেশ্য হল বিশ্বপ্রভুর বিশ্বজনীন দ্বীন গোটা বিশ্ববাসীর সামনে আসলরূপে উপস্থাপন করা।

ইসলাম শান্তির ধর্ম, সমাজের সকল স্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠা ইসলামের লক্ষ্য। বিশ্ব ইজতেমা মানুষকে সামাজিক হিসাবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। ধনী-দরিদ্র, গ্রাম্য-শহুরে নির্বিশেষে এক মহামিলন ক্ষেত্র এ বিশ্ব ইজতেমা। সেখানে কোন ধরনের গণ্ডগোল/হট্টগোল, মারামারি, হানাহানির নজীর নেই। এ সমাবেশ হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ। এটা প্রমাণ করে যে, সমাজ এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছে।

তাবলীগ জমায়েত একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যা সকলেরই জানা আছে বিধায় বর্তমান বিশ্বে (বাংলাদেশেও) প্রচলিত রাজনীতির সাথে এজতেমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কমর্ীদেরকে এক জায়গায় একত্রিত করে তাদের মতপার্থক্য ও ভিতরকার বিভেদ কমিয়ে আনতে সহায়তা করছে।

হাজার হাজার বিদেশীর এজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশে আগমনের দ্বারা একদিকে যেমন তাদের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশে বিদেশী মেহমানদের আগমন ও এদেশে তাদের দীর্ঘ সময় অবস্থানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। উপরন্তু এ উপলক্ষে এজতেমাস্থলের চারপাশের লোকসহ সারাদেশের অগণিত মানুষের ব্যবসা ও আয়ের একটা বড় ব্যবস্থা হচ্ছে।

একটু খোলা নজরে লক্ষ্য করলে সহজেই অনুভব করা যাবে যে, এজতেমার ওসীলায় কত শত মানুষ সংশোধন হচ্ছে এবং কত মানুষ নৈতিকতা ও ধর্মবিবর্জিত জীবন পরিত্যাগ করে সঠিক ধমর্ীয় ও নৈতিক শিক্ষায় আলোকিত জীবন গ্রহণ করছে। সুতরাং সকল শ্রেণীর মানুষের আনুকূল্য পেলে আরও কার্যকর ভূমিকা এজতেমা পালন করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর শেখ মো: তৈয়েবুর রহমান নিজামী।

বিশ্ব ইজতেমা থেকে ঐক্যের সূত্রপাত হোক

তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস (র:) যে সময় এই জামায়াতের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে সময় এ উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন চলছে। এ কারণে দিলস্নীর মেওয়াত এলাকা হতে তিনি ইসলামের প্রাথমিক কিছু বিষয় নিয়ে দাওয়াতী কাজ শুরু করেছিলেন। পরবতর্ীতে সেটি ব্যাপক জনিপ্রয়তা লাভ করায় বিশ্বের প্রায় একশতটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাবলীগ জামায়াত ইসলামের প্রারম্ভিক কিছু বিষয়ের ওপর দাওয়াতী কাজ করছে। তবে ইসলামের বিস্তীর্ণ অঙ্গন সম্মুখে রয়ে গেছে। সে সমস্ত বিষয়গুলোরও দাওয়াত এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে দেশ হতে দারিদ্র্য বিদূরিত করা সহজ হবে। তাছাড়া শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, সুদ-ঘুষ, দুনর্ীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদমূলক কাজেও তাদের সোচ্চার হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। মানব সেবার বিষয়টিও তারা কর্মসূচীর মধ্যে রাখবেন। আমরা চাই সেই পূর্ণতা প্রাপ্তির দাওয়াতী কাজে তারা আত্মনিয়োগ করুক। বিশ্ব ইজতেমার সাফল্য কামনা করছি।

মাওলানা মোফাজ্জল হুসাইন খান

ইসলামী চিন্তাবিদ, সাবেক পরিচালক

ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ

সাক্ষাৎকার গ্রহণে

মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী, হাসান ইলিয়া

বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা

সরদার আনোয়ার হোসেন

মাওলানা যোবায়েরুল হাসান সাহেব শুধু টঙ্গীতে নয়, সারা বিশ্বে যেসব বড় বড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তার আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করে থাকেন।

এর আগে উনার আব্বাজি মাওলানা এনামুল হাসান হযরত জ্বী বিশ্ব ইজতেমার মোনাজাত পরিচালনা করতেন। ১৯৮০ সালে ভারতের চবি্বশ পরগনার মগরহাটে একটি ইজতেমায় বাংলাদেশ হতে অনেক জামাতী ভাই যোগদান করেছিলেন, এর আগে পশ্চিম বঙ্গ প্রদেশে এত বড় ইজতেমা হয়নি, এই ইজতেমা দিলস্নীর মারকাজ হতে হযরত জ্বী মরহুম এনামুল হাসান তাসরীফ এনেছিলেন এবং বাংলাদেশের আমিরয় মাওলানা আবদুল আজিজ খুলনাবী উপস্থিত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের আমির মাওলানা গোলাম আলী সাহেব এই ইজতেমার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন।

ইজতেমা চলাকালীন মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেব এবং মাওলানা গোলাম আলী সাহেব যে রুমে অবস্থান করেছিলেন, সেখানে তাদের খেদমতে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

দু'জনেই পড়াশুনা করেছেন কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায়, তখন ব্রিটিশ ভারতে কলকাতা শহরে দুই বন্ধু একটি কামরা ভাড়া নিয়ে আলীয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতেন। একদিন শুনলেন দিলস্নী হতে মাওলানা ইলিয়াস কলোটুলা মসজিদে তাবলীগী মেহনতের উপরে কথা বলবেন, সেই মসজিদে দুই বন্ধু মাওলানা ইলিয়াসের দাওয়াতের তাশকিলে সাড়া দিয়ে পরীক্ষার পর দিলস্নীর নিজামুদ্দিনে গিয়ে দ্বিনের দাওয়াতে অংশ নিবেন। পরবতর্ীতে যথাসময়ে দিলস্নীর নিজামুদ্দীনে মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের খেদমতে গিয়ে উপস্থিত হলেন, সেই থেকে অর্থাৎ ১৯৪৪ সালে এবং মাওলানা আ: আজিজ সাহেবকে পূর্ব বাংলার এবং মাওলানা আঃ হাকিম সাহেবকে পশ্চিম বাংলা ও আসামের আমির নিযুক্ত করে সমগ্র বাংলায় তাবলীগের কাজকে ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সেই থেকে এই দুই বন্ধু শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাবলীগের মেহনতে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একটি জামাত নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে করাচীতে গেলে মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেবসহ জামাতের সব ভায়েরা আটকা পড়েন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জানুয়ারি মাসে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে টঙ্গীর এই ময়দানে সর্ব প্রথম বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের আমীর মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেব খুলনা জেলার তেরখাদা থানায় এক দ্বীনদার খাঁন পাঠান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

কয়েকশত বছর পূর্বে আফগানিস্তান হতে পূর্ব পুরুষেরা এদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। বাংলাদেশের জলবায়ু ও উষ্ণ আবহাওয়া এই পাঠান বংশের শারীরিক অবকাঠামোর উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেবের গোলাপী রঙের নূরানী চেহারা এবং বিশ্বাস দেশের অবকাঠামো দেখলে দৃষ্টি ফিরানো কঠিন ছিল। একবার ভারতের উত্তর প্রদেশে সফরে গিয়ে ১৯৮৩ সালে দিলস্নী যাওয়ার জন্য একটি বাসে উঠলে সেই বাসের যাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে উনাকে এবং উনার সঙ্গীদের বসার জায়গা করে দিয়েছিল। বাসের চালক পিছন দিকে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখে হিন্দি গানের রেকর্ড সাথে সাথে বন্ধ করে দিলেন। এই দৃশ্য আমার নিজের চোখে দেখা। পাকিস্তান আমলে অস্থায়ীভাবে টঙ্গীর ময়দানে কয়েকবার ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নিকট ইজতেমার জন্য এই ময়দানকে চিরস্থায়ীভাবে দেয়ার অনুরোধ জানালে বঙ্গবন্ধু কালবিলম্ব না করে বিশ্ব ইজতেমার জন্য প্রায় ১৬০ একর জমি তাবলীগের ইজতেমা ও আনুষঙ্গিক কাজের জন্য বন্দোবস্ত করেছিলেন। ইসলামের খেদমতের জন্য এত মূল্যবান জমি কোন সরকারই, বেসরকারী পর্যায়ে বিনা পয়সায় বন্দোবস্ত দেয়নি। প্রতি বছর টঙ্গীর ময়দানে মুসলস্নীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আখেরী মোনাজাতের দিন ঢাকাবাসী মোনাজাতে শরিক হওয়ার জন্য টঙ্গীর দিকে ধাবিত হন। এ ছাড়া কয়েকদিন আগে হতে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মুসলস্নীগণ টঙ্গীর ময়দানে অবস্থান করে থাকেন। আখেরী মোনাজাতের দিন জনসমুদ্র রোড, ঘাট, পথ-প্রান্তর ভরিয়ে বিমান বন্দর পর্যন্ত পস্নাবিত হয়। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রায় নব্বই ভাগ মসজিদ এই দাওয়াতের আওতায় এসেছে। এশিয়া মহাদেশসহ বিশ্বের বাকি সব মহাদেশের যেসব লক্ষ লক্ষ মসজিদ রয়েছে তার মধ্যে আশি ভাগ মসজিদ দাওয়াতের আওতায় এসেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হল ঢাকার টঙ্গীতে। দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় ভারতের ভূ-পালে। তৃতীয় সর্ববৃহৎ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের রায়ব্যান্ডে। একমাত্র বাংলাদেশেই সর্বাধিক বিদেশী মেহবান যোগদান করে থাকেন। বাংলাদেশে সরকারী-বেসরকারীভাবে এমন কোন অনুষ্ঠান বা কর্মকাণ্ড হয় না যেখানে বিদেশী মেহমবান এত সংখ্যাধিক্যভাবে যোগদান করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ভিসা অফিসগুলো তাদের ভিন্ন ফরমে তাবলীগ শব্দ উলেস্নখ করা ভিসা আবেদনের ব্যবস্থা রেখেছে। তাই বিদেশী মেহমান বাংলাদেশের এই বিশ্ব ইজতেমায় বারো মাস ধরে যে কোনো সময় সহজে ভিসা নিয়ে আসতে পারেন। এই সুযোগ বা এই সুবিধা অন্য কোন দেশের ভিসা অফিসে নেই। সেখানে শুধুমাত্র ভিজিট বা ট্রাভেল আবেদনের মাধ্যমেই ভিসা নিতে হয়। ভারতের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডক্টর জাকির হোসেন, যিনি দিলস্নীর জামেয়া মিলিস্নয়া ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন, তাবলীগ জামাতে অংশ নিয়ে একবার লন্ডন গিয়েছিলেন। লোকে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এই তাবলীগ কি ইসলামের কোন নতুন পদ্ধতি নাকি নতুন সংস্করণ? জবাবে তিনি বলেছিলেন, এই তাবলীগ মূলত ইসলামের মৌলিক ভিত বা ফাউন্ডেশন। সাহাবীগণ (রা:) যেই তাবলীগের মাধ্যমে ইসলামের ভিতকে মজবুত করার জন্য মেহনত করেছিলেন আমি সেই মেহনতের সন্ধান পেয়ে সুদূর ভারত থেকে লন্ডন এসেছি, যাতে এখানে এই মেহনতের দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেয়া যায়। আমাদের বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে মানুষের দৃষ্টিতে একটি হতদরিদ্রের দেশ-এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ সাহাবীদের এই দাওয়াতী কাজ কাঁধে নিয়ে টঙ্গীতে যেন জেগে উঠেছে।

ইসলামী দাওয়াহ : মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব

ড. মু. বিলাল হুসাইন

ইসলামী দাওয়াত মুসলমানদের জন্য আলস্নাহ তায়ালার পক্ষ হতে এক অফুরন্ত নিয়ামত। এজন্য ইসলামে দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। যে কারণে অসংখ্য নবী-রাসূল এ পৃথিবীতে আগমন করেছেন। 'দাওয়াহ' আরবী শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ-আহ্বান করা, ডাকা। পরিভাষায় সকল মানব সমাজকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কার্যক্রমকে ইসলামে দাওয়াত হিসাবে গণ্য করা হয়। এ দাওয়াত মানুষকে অশান্তি থেকে শান্তির দিকে, অকল্যাণ থেকে কল্যাণের দিকে, সংকীর্ণতা থেকে উদারতার দিকে, জাহান্নাম থেকে জান্নাতের দিকে এবং পশ্চাৎপদতা থেকে প্রগতির দিকে ধাবিত করে। আলস্নাহর সাথে মানব জাতির সম্পর্ক দৃঢ় করতে দাওয়াত সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

ইসলামী দাওয়াতের কর্মসূচি মানুষের জন্য কল্যাণকর। মহান আলস্নাহ তায়ালা মানব জাতির মধ্য থেকে কিছু লোককে বাছাই করে দাওয়াতের জন্য মনোনীত করেছেন। তাদেরকে আলস্নাহ তায়ালা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম (আ.) এ দাওয়াতের কার্যক্রমের সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে হযরত নূহ (আ.), হুদ (আ.), সালিহ (আ.), ইয়াকুব (আ.), ও ইউসুফ (আ.) থেকে হযরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত অসংখ্য নবী-রাসূলের মাধ্যমে এ ধারা অব্যাহত রাখেন। তাঁরা আলস্নাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আসা বাণীগুলো সর্বস্তরের মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতেন।

মহান আলস্নাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীবকে প্রেরণ করেছিলেন সকল জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য। ফলে মহানবী (সা.)-এর দাওয়াত ছিল সর্বজনীন। পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণ বিশেষ কোন গোত্র, গোষ্ঠী বা অঞ্চলের অধিবাসীকে দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে তাদের দাওয়াত সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। মহানবী (সা.) সকল জাতি, গোষ্ঠীর কাছে আলস্নাহ প্রদত্ত দাওয়াত দিয়েছেন। মহান আলস্নাহ তায়ালা এজন্যই তাকে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন_"আপনি বলুন, হে মানবমন্ডলী ! আমি তোমাদের সবার প্রতি আলস্নাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল"। (সুরা আল-আ'রাফ : ১৫৮)। তাঁর অবর্তমানে দাওয়াতের এ গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় মুসলিম উম্মাহর প্রতি। যারা কিয়ামত পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবেন।

রিসালাতের এই দায়িত্বের কারণেই মুসলিম উম্মাতকে 'সর্বোত্তম জাতি' বলা হয়েছে। মুসলমানরা যদি এই দায়িত্ব পালনে নিবৃত থাকে তাহলে অন্য জাতির সাথে পার্থক্য করা যাবে না। অন্য জাতির মধ্যে না আছে কোন বিশেষ সৌন্দর্য, আর না আছে বিশেষ মর্যাদা লাভের কোন কারণ। আলস্নাহ তায়ালারও দেখার প্রয়োজন নেই যে, তারা দুনিয়াতে সসম্মানে বসবাস করছে, না অপমানিত অবস্থায় জীবন যাপন করছে। বরং এই দায়িত্ব ভুলে যাবার কারণে পূর্বে অন্য জাতির ন্যায় আলস্নাহর অভিশাপে পতিত হবে।

ইসলামী দাওয়াত সমাজ সুন্দরের অন্যতম হাতিয়ার। সমাজের সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, মারামারি, দুর্নীতি, ব্যক্তি চরিত্র নষ্টসহ সকল অপরাধ নিমর্ূলে ইসলামী দাওয়াত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। কেননা এ দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তু হলো সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ। সেহেতু ব্যক্তি সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে। পাপাচারযুক্ত এ সমাজে ইসলামী দাওয়াতই মানব সমাজের কাছে আশার আলো প্রজ্বলিত করতে পারে।

মুসলিম উম্মাহ দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এটাই স্বভাবিক। কেননা মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নির্ভর করে এ দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনার উপর। সকল অন্যায় অত্যাচারের যাঁতাকল থেকে বিশ্ব মানবতাকে মুক্ত করে একটি সুখী-সমৃদ্ধ পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব এ উম্মতেরই। আলস্নাহ তায়ালা বলেন_'তোমরাই শ্রেষ্ঠতম উম্মত। মানুষের কল্যাণার্থেই তোমাদের বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দিবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আলস্নাহর প্রতি ঈমান রাখবে।' (আলে ইমরান:১১০)

ইসলামী দাওয়াতের বাস্তবায়ন তড়িঘড়ি কোন বিষয় নয়। ইসলামী দাওয়াতী কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকার কোন সুযোগ মুসলিম উম্মাহর নেই। সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারে পৃথিবী যখন জর্জরিত তখনই অবিরাম দাওয়াতী কার্যক্রমই পারে বিপন্ন মানবতাকে মুক্তির সন্ধান দিতে। মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে দাওয়াতের বিকল্প কিছুই নেই। এ দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ-দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী মানবতা মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করতে পারে। এতে ছেদ পড়লে মানব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। মহানবীও (সা.) এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন_ আমি সেই সত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ অবশ্যই তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দিবে এবং অসৎ কাজ হতে মানুষকে বিরত রাখবে। নতুবা তোমাদের উপর শীঘ্রই আলস্নাহর শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তখন তোমরা আলস্নাহর কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকবে কিন্তু তোমাদের প্রার্থনা কবুল করা হবে না। (তিরিমিযী)

অতএব সামাজিক অশান্তি দূর করা ও মানবতার মুক্তির জন্য সকলকে একযোগে দাওয়াতী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। নিজেদের পরিশুদ্ধ হতে হবে এবং অন্যদের মাঝে চিন্তার পরিশুদ্ধি ঘটাতে হবে। তবে আমরা নতুন প্রজন্মের মাঝে একটি কল্যাণময় সমাজ উপহার দিতে সক্ষম হব এবং পরকালে লাভ করতে পারবো চূড়ান্ত সফলতা।

তাবলীগ ও ইসলাম

আলী হায়দার

দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার ও বোঝানোর জন্য প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয় ঢাকায়। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এখানে একত্রিত হয়। এই একত্রিত হওয়ার উদ্দেশ্য শুধু তাবলীগী কাজ বুঝে নেয়া। দাওয়াত অর্থ আহবান করা। কিসের আহবান? দ্বীনের দিকে আহবান করা। আর তাবলীগ অর্থ প্রচার করা। দ্বীনের কথা প্রচার করা। দ্বীনের কথা প্রচার করা প্রত্যেক নর-নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। আলস্নাহ যে ভাবে তার ওপর আনুগত্য ও ইবাদত ফরজ করেছেন ঠিক তেমনিভাবে ইসলামের এই দাওয়াতী কর্ম অন্যরা বান্দাদের ওপর পেঁৗছে দেওয়া আমাদেরকে নির্দেশ করেছেন। মুসলমানদের প্রতি বড় নির্দেশ এই যে, নিজেদেরকে কোরআন ও সুন্নাহর অনুসারী করে নেয়া যতটুকু জরুরী অন্য মুসলমানদেরকেও ঈমান ও সৎকর্মের অনুসারী বা আহবান করা ততটুকু জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করাই দাওয়াত ও তাবলীগী কাজ। এটাই হচ্ছে দ্বীনের মূল দাওয়াত।

বিশ্বে অনেক ধর্ম রয়েছে। সকল ধর্মের মধ্যে আলস্নাহর কাছে মনোনীত ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে আলস্নাহর নিকট গ্রহণীয় ধর্ম হচ্ছে ইসলাম (আল ইমরান-১০)। আলস্নাহ বলেন, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম আর তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সমাপ্ত করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম (মায়েদা-০৩)। ইসলাম মুসলমানদের ধর্ম এবং এই ধর্মানুসারে আলস্নাহ আমাদের ওপর তার যথার্থ আনুগত্য ও ইবাদত ফরজ করেছেন। এই দ্বীন ও ইসলামের অমিয় বাণী তার অন্য বান্দাদের ওপর পেঁৗছে দেয়া আমাদের ওপর ফরজ করেছেন। আলস্নাহপাক যুগে যুগে এ কাজে নবী-রাসূলগণকে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা দুঃখ-যন্ত্রণা ও ক্লেশ সহ্য করে এ কাজের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এ ধারবাহিকতা আখিরী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত এসে সমাপ্ত হয়ে যায়। নবুয়ত ও রিসালাতের ধারবাহিকতা সমাপ্ত হওয়ার পর মানুষের সংশোধনের দায়িত্ব বর্তায় নবী মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতগণের ওপর। দ্বীনের প্রতি আহবান ও দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা করে মহান আলস্নাহ বলেন, (হে উম্মতি মুহম্মদী) তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজে নির্দেশ কর ও অসৎ কাজে নিষেধ কর এবং আলস্নাহর ওপর ঈমান আনয়ন কর (আল ইমরান)।

এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি পৃথিবীতে যত উম্মত এসেছে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম উম্মত হল উম্মতে মুহাম্মদী। এই উম্মতের তিনটি দায়িত্ব অবশ্যই পালন করতে হবে। সৎ কাজের নির্দেশ প্রদান করতে হবে। অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে হবে। আলস্নাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।

প্রিয় নবী (স.) এর আদর্শ বাস্তবায়ন ও মানবতার সার্বিক কল্যাণ সাধন করা আর এই মহান কাজের মধ্যেই রয়েছে উত্তম জাতির পরিচয়। আর এই অর্পিত দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করতে পারলে তার মধ্যেই শ্রেষ্ঠ উম্মতের মাহাত্ম্য বজায় থাকবে। বলা হয়েছে, "হে মুসলিম জাতি! আলস্নাহর প্রতি বিশ্বাস পরিপূর্ণ ও সুদৃঢ় করো। অন্যায়-অত্যাচারকে প্রতিরোধ করো এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করো।" (তাফসীরে নূরুল কুরআন)।

বর্তমানে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া কিংবা দ্বীনের খেদমত করা এবং বিশ্ববাসীকে সংশোধনের দিক-নির্দেশনা প্রদান করা, যৎসামান্য মুসলমানই এ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এমতাবস্থায় আমাদের প্রথম কর্তব্য হবে দ্বীনের দাওয়াত ও হেদায়েতের পথ উম্মতের মাঝে চালু করা, যারা দ্বীন, ঈমান ও সৎ কাজ থেকে গাফিলতের অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সুতরাং এসব মানুষের সংশোধনের জন্যই এ দাওয়াতী ও তাবলীগী কাজ।

আল কুরআনে তাবলীগের ফজিলত

তাবলীগ অর্থ প্রচার করা, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। গুটিকয়েক লোক যারা ইসলামের দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে আলস্নাহ্ ও তাঁর রাসূলের বাণী প্রচার করেন। তাদের এই দলবদ্ধ কার্যক্রমকে তাবলীগ বলে। আলস্নাহ তায়ালা তাবলীগের কাজটি ব্যক্তিগতভাবে, সমষ্টিগতভাবে সবার ওপর ফরয করে দিয়েছেন। তাবলীগের ফযীলত ও উৎসাহ প্রদান সম্পর্কে বহু আয়াত এবং হাদীস নাযিল হয়েছে। কতিপয় হাদীস নিচে তুলে ধরা হলোঃ

হে মুহাম্মদ! আপনি লোকদেরকে নসীহত করতে থাকুন, কেননা নসীহত মুমিনদেরকে ফায়দা পেঁৗছাবে।

(সূরা যারিয়াত, আয়াত: ৫৫)

হে মুহাম্মদ (স.)! আপনি আপনার পরিবার পরিজনকে নামাযের হুকুম করতে থাকুন এবং নিজেও তার পাবন্দি করুন। আমি আপনার নিকট রিযিক চাই না এবং রিযিক আপনাকে আমিই দিব আর উত্তম পরিণতি তো পরহেযগারীর জন্যই।

(সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১৩২)

তোমাদের মধ্য হতে একটি জামাত এমন হওয়া জরুরী; যারা মঙ্গলের দিকে আহবান করবে, সৎ কাজে আদেশ করবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে তারাই পূর্ণ কামিয়াব হবে।

(সূরা আল ইমরান, আয়াত: ১০৪)

সাধারণ লোকদের অধিকাংশ পরামর্শের মধ্যে কোনো খায়র (বরকত) নাই, তবে যারা দান-খয়রাত বা কোনো এক কাজ কিংবা মানুষের পরস্পর সংশোধনের জন্য উৎসাহ প্রদান করে (এবং এই তালীম ও তারগীবের জন্য গোপনে চেষ্টা-তদবীর ও পরামর্শ করে) তাদের পরামর্শের মধ্যে অবশ্যই খায়র (বরকত) আছে। আর যারা (ভাল কাজে উৎসাহ প্রদানের) এই কাজ (লোভ লালসা ও সুনাম অর্জনের উদ্দেশ্য ব্যতীত) শুধু আলস্নাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই করে, তাদেরকে আমি অতি সত্বর বিরাট পুরস্কার দান করবো।

(সূরা নিসা, আয়াত: ১০৪)

তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (মঙ্গলের) জন্য তোমাদেরকে বাহির করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজে আদেশ করতে থাকো, অসৎ কাজ হতে নিষেধ করতে থাকো এবং আলস্নাহর ওপর ঈমান রাখো।

(সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)

তাবলীগের ফযীলত কতখানি তা বলে শেষ করা যাবে না। এই কাজ বিশেষভাবে গুরুত্ব সহকারে করতে হবে। যে বিষয় নিয়ে তাবলীগ করা হচ্ছে সে বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান আহরণ করে গুরুত্ব সহকারে এবং আলস্নাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই এই কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আলস্নাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এই দ্বীনি কাজে শামিল করুন, আমীন।

সোনিয়া লায়লা

No comments:

Post a Comment