Thursday, 6 December 2012

জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও ইসলামের বিধান

জন্ম নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের পটভূমি :

জন্ম নিয়ন্ত্রণ (Birth control) আন্দোলন আঠারো শতকের শেষাংশে ইউরোপে সূচনা হয়। সম্ভবত: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসই (Malthus) এর ভিত্তি রচনা করেন। এ আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য হ’ল বংশ বৃদ্ধি প্রতিরোধ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার দেখে মি. ম্যালথাস হিসাব করেন, পৃথিবীতে আবাদযোগ্য জমি ও অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান সীমিত। কিন্তু বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমাহীন। ১৭৯৮ সালে মি. ম্যালথাস রচিত An essay on population and as it effects, the future improvment of the society. (জনসংখ্যা ও সমাজের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে এর প্রভাব) নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম তার মতবাদ প্রচার করেন। এরপর ফ্র্যান্সিস প্ল্যাস (Francis Place) ফরাসী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার প্রতি জোর প্রচারণা চালান। কিন্তু তিনি নৈতিক উপায় বাদ দিয়ে ঔষধ ও যন্ত্রাদির সাহায্যে গর্ভনিরোধ করার প্রস্তাব দেন। আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার চার্লস নোল্টন (Charles knowlton) ১৮৩৩ সালে এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন সূচক উক্তি করেন। তিনি তার রচিত The Fruits of philosophy নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধের চিকিৎসা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং এর উপকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

কিন্তু মাঝখানে ১৮৪০ সাল থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন বন্ধ থাকে। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা এর প্রতি কোনরূপ গুরুত্বারোপ ও সহযোগিতা করতে অস্বীকার জানিয়েছিলেন।

আবার ১৮৭৬ সালে নতুন করে ম্যালথাসীয় আন্দোলন (New Malthusian Movment) নামক নতুন আন্দোলন শুরু হয়। মিসেস এ্যানী বাসন্ত ও চার্লস ব্রাডার ডাঃ নোল্টনের (Fruits of philosophy) গ্রন্থটি ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ডাঃ ড্রাইসডেল (Drysdale)-এর সভাপতিত্বে একটি সমিতি গঠিত হয় ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচার কার্য শুরু হয়ে যায়।

১৮৭৯ সালে মিসেস বাসন্ত-এর রচিত Law of population (জনসংখ্যার আইন) নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ সালে হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানীতে এ আন্দোলন ছড়িয়ে যায় এবং ক্রমে ইউরোপ ও আমেরিকার সকল সভ্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানে স্থানে জন্মনিরোধ ক্লিনিক (Birth Control Clinics) খুলে দেয়। [1]

বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে প্রকাশ্যে সন্তান হত্যার হিড়িক পড়ে গেছে। এমনকি দৈনিক পত্রিকাসহ সকল মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচারণা চলছে। যেমন ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট’, দুইটি সন্তানের বেশী নয়, একটি হ’লে ভালো হয়’ ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু স্যাটেলাইট ক্লিনিক গর্ভবর্তী মায়ের সেবার নামে গর্ভপাত ঘটানোর গ্যারেজে পরিণত হয়েছে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি :

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি দু’প্রকার : (১) সাময়িক ব্যবস্থা ও (২) স্থায়ী ব্যবস্থা।

(১) সাময়িক ব্যবস্থা :

(ক) আযল তথা ভিতরে বীর্যপাত না করা (With drawal)

(খ) নিরাপদ সময় মেনে চলা (Safe period) ।

(গ) কনডম ব্যবহার। (ঘ) ইনজেকশন পুশ। (ঙ) পেশীতে বড়ী ব্যবহার। (চ) মুখে পিল সেবন ইত্যাদি।

(২) স্থায়ী ব্যবস্থা :

(ক) পুরুষের অপারেশন। (খ) নারীর অপারেশন।

(ক) পুরুষের অপারেশন : পুরুষের অন্ডকোষে উৎপাদিত শুক্রকীটবাহী নালী (Vas deferens) দু’টি কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে, কিন্তু বীর্যে xy ক্রমোজম শুক্রকীট না থাকায় সন্তান হয় না। [2]

(খ) নারীর অপারেশন : নারীর ডিম্বাশয়ে উৎপাদিত ডিম্ববাহী নালী (Fallopian Tube কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পূর্ণ xx ক্রমোজম ডিম্ব (Matured Ovum) আর জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে না। [3]

নারী অথবা পুরুষে যেকোন একজন স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, অপর জনকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় না। কারণ নারীর ডিম্ব পুরুষের শুক্রকীট দ্বারা নিষিক্ত না হ’লে সন্তানের জন্ম হয় না। [4]
জন্ম নিয়ন্ত্রণের কুফল :

জন্মনিয়ন্ত্রণের বহুবিদ কুফল রয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল-

ব্যাভিচারের প্রসার :

ব্যাভিচার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَّسَاءَ سَبِيْلاً

‘তোমরা অবৈধ যৌন সম্ভোগের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (ইসরা ১৭/৩২)

কিন্তু শয়তান মানুষকে দরিদ্রতার ভয় দেখিয়ে অসামাজিক, অনৈতিক কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে। নারী জাতি আল্লাহভীতির পাশাপাশি আরও একটি নৈতিকতা রক্ষা করতে বাধ্য হয়। তাহ’ল অবৈধ সন্তান জন্মের ফলে সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট হবার আশংকা। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়ার ফলে, এ আশংকা থেকে একদম মুক্ত। যারা নৈশক্লাবে নাচ-গান করে, পতিতা বৃত্তি করে, প্রেমের নামে রঙ্গলীলায় মেতে উঠে, তারা অবৈধ সন্তান জন্মানোর আশংকা করে না। তাছাড়া কখনও হিসাব নিকাশে গড়মিল হয়ে অবৈধ সন্তান যদিও গর্ভে এসে যায়, তবে স্যাটেলাইট ক্লিনিক নামের সন্তান হত্যার গ্যারেজে গিয়ে প্রকাশ্যে গর্ভ নষ্ট করে ফেলে।

ইংল্যান্ডে প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৮৬ জন নারী বিয়ে ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। অবৈধ সন্তান জন্মের সময় এদের শতকরা ৪০ জন নারীর বয়স ১৮-১৯ বছর, ৩০ জন নারীর বয়স ২০ বছর এবং ২০ জন নারীর বয়স ২১ বছর। এরা তারাই যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরও এ দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়েছিল। [5] সেখানে প্রতি তিন জন নারীর একজন বিয়ের পূর্বে সতীত্ব সম্পদ হারিয়ে বসে। ডাঃ চেসার তার রচিত ‘সতীত্ব কি অতীতের স্মৃতি?’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছেন’। [6]

Indian Council for Medical Research-এর ডিরেক্টর জেনারেল অবতার সিংহ পেইন্টাল বলেন, We used to think our women were chaste, But people would be horrified at the level of promise culty here. অর্থাৎ আমাদের নারীদেরকে আমরা সতী বলে মনে করতাম। কিন্তু অবৈধ যৌনকর্ম এখানে এতবেশী বৃদ্ধি পেয়েছে যে, লোকে এতে ভীত না হয়ে পারে না। [7]

আমেরিকার বিদ্যালয় সমূহে অশ্লীল সাহিত্যের চাহিদা সর্বাপেক্ষা বেশী। যুবক-যুবতীরা এসব অধ্যয়ন করে অশালীন কাজে লিপ্ত হয়। এছাড়া হাইস্কুলের শতকরা ৪৫ জন ছাত্রী স্কুল ত্যাগ করার পূর্বে চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। আর এদের যৌন তৃষ্ণা অনেক বেশী। [8] বৃটেনেও শতকরা ৮৬ জন যুবতী বিয়ের সময় কুমারী থাকে না। [9] প্রাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে তাদের শিক্ষা ব্যয়ের প্রায় অধিকাংশ খন্ডকালীন যৌনকর্মী হিসাবে অর্জন করে থাকে। মঙ্গোলয়েড দেশসমূহে যৌন সম্পর্কীয় বিধি-বিধান অত্যন্ত শিথিল। থাইল্যান্ডের ছাত্রীদের বিপুল যৌনতা লক্ষ্য করা যায়। [10]

চীনের ক্যান্টন শহরে কুমারীদের প্রেম বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য বিদ্যালয় খোলা হয়েছে। [11] পশ্চিমা সভ্যতার পূজারীরা সর্বজনীন অবৈধ যৌন সম্পর্কের মহামারীর পথ প্রশস্ত করেছে। [12] চীনে যৌন স্বাধীনতার দাবী সম্বলিত পোষ্টারে যার সাথে খুশী যৌন মিলনে কুণ্ঠিত না হবার আহবান জানানো হয়। [13] ইউরোপে যৌন স্বাধীনতার দাবীতে পুরুষের মত নারীরাও নৈতিকতা হারিয়ে উচ্ছৃংখল ও অনাচারী এবং সুযোগ পেলেই হন্যে হয়ে তৃপ্ত করত যৌনক্ষুধা। অশুভ এই প্রবণতার ফলে বৈবাহিক জীবন ও পরিবারের প্রতি চরম অনিহা সৃষ্টি হয়। [14] অর্থ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে আমেরিকার ৭৫ লাখ নারী পুরুষ বিবাহ ব্যতীত ‘লিভ টুগেদার’-এ। [15]

প্রাশ্চাত্যের যুবতীরা যাতে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভবতী না হয়ে পড়ে, সেজন্য তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে গর্ভনিরোধের দ্রব্যাদি দেয়া হয় এবং এ সকল দ্রব্য ব্যবহারের বিষয়ে তাদেরকে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়ে থাকে। এমনকি মায়েরা কন্যাদেরকে এই সকল দ্রব্য ব্যবহারের কায়দা-কৌশল শিক্ষা দিয়ে থাকে। গর্ভনিরোধ দ্রব্যাদির ব্যবহার সম্পর্কে স্কুল-কলেজে প্রচারপত্র বের করে এবং বিশেষ কোর্সেরও প্রবর্তন করে। এর অর্থ হ’ল- সকলেই নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছে যে, যুবক-যুবতীরা অবৈধ যৌন সম্ভোগ করবেই। [16]

প্রাশ্চাত্যে ক্রমবর্ধমান অবৈধ যৌন স্বাধীনতাই সবচাইতে ক্ষতি সাধন করেছে। নারীর দেহকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়ার কোন প্রচেষ্টাই বাকী রাখা হয়নি। অবিবাহিত মহিলাদের গর্ভধারণের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবৈধ সন্তান জন্ম, গর্ভপাত, তালাক, যৌন অপরাধ ও যৌন ব্যাধিই এর প্রমাণ। অপর দিকে অবৈধ যৌন সম্পর্কের ফলে কোন আইন-বিচার ও আইনী শাস্তির বিধান নেই। বরং এটাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিবেচনা করা হয়। [17]

সম্প্রতি ভারতেও অবৈধ যৌন সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলমান যুবক-যুবতীর নির্বিঘ্নে বিবাহ বন্ধন এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের নামে গর্ভপাত ঘটানোর হিড়িক পড়ে গেছে।

জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব :

নারীর ব্যাভিচার দিনদিন প্রসার লাভ করে চলেছে। নারী স্বাধীনতার নামে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। এই অবৈধ যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মারাত্মক জটিল সব রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জীবাণু নাশক ঔষধ, পিল, কনডম ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহারের ফলে তৎক্ষণা কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু বেশ কিছু কাল যাবৎ এসব ব্যবহার করার ফলে মধ্যবর্তী বয়সে উপনীত হ’তে না হ’তেই নারী দেহের স্নায়ুতন্ত্রীতে বিশৃংখলা (Nervous instability) দেখা দেয়। যেমন- নিস্তেজ অবস্থা, নিরানন্দ, উদাসীনতা, রুক্ষমেজায, বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতা, মস্তিষ্কের দুর্বলতা, হাত-পা অবশ, শরীরে ব্যথা, স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, ক্যান্সার, অনিয়মিত ঋতু, সৌন্দর্য নষ্ট ইত্যাদি। [18] নারী-পুরুষ অবৈধ যৌন মিলনে সিফিলিস, প্রমেহ, গণরিয়া, এমনকি এইডস-এর মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যে সমস্ত বিবাহিতা নারীর দেহে অস্ত্রপচার করা হয়, তাদের শতকরা ৭৫ জনের মধ্যেই সিফিলিসের জীবাণু পাওয়া যায়। [19]

সিফিলিস রোগে আক্রান্ত রোগী সুচিকিৎসা গ্রহণ না করলে মারাত্মক সব রোগের সৃষ্টি হয়। এইডস রোগের ভাইরাসের নাম এইচ. আই. ভি (HIV)। এ ভাইরাস রক্তের শ্বেত কণিকা ধ্বংস করে। এ রোগ ১৯৮১ সালে প্রথম ধরা পড়ে এবং ১৯৮৩ সালে একজন ফরাসী বিজ্ঞানী এইচ. আই. ভি ভাইরাসকে এই রোগের কারণ হিসাবে দায়ী করেন। [20] বল্গাহীন ব্যাভিচারের ফলে এই রোগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ডাঃ হিরোশী নাকজিমা বলেন, জনসাধারণের মধ্যে এইডস বিস্তার লাভ করলে সমগ্র মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। [21]

এছাড়া জন্ম নিরোধ পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে নানা প্রকার রোগ বদঅভ্যাসের প্রসার ঘটেছে। তন্মধ্যে কনডম ব্যবহার বা আযল করার জন্য নারীরা মিলনে পরিতৃপ্ত না হ’তে পেরে অবৈধ মিলনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, স্তনচাকা বা পিন্ড, স্তন ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে স্তনে এ ধরনের ব্যথা ও পিন্ড তৈরী হয় এবং ৭৫% নারী স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে। [22] বুক ও জরায়ুর কার্সিনোমা হ’তে পারে শর্করা জাতীয় খাদ্য সহ্য হয় না, লিভার দুর্বল হয়, রক্ত জমাট বাঁধতে ব্যহত হয়, বুকের দুধ কমে যায় এবং Lactation কম হয় এবং দেহে ফ্যাট জমা হয়। [23] এছাড়া জরায়ু ক্যান্সার ও স্থানচ্যুতি সহ আরও অনেক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জন্মের হার কমে যাওয়া :

আগত ও অনাগত সন্তান হত্যার ব্যাপারে মহান আল্লাহ নিষেধ করেন

وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاَقٍ

‘তোমরা অভাব ও দরিদ্রতার আশংকায় তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না’(ইসরা ১৭/৩১)

কিন্তু শয়তান আল্লাহর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলল,

وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللّهِ

‘আমি অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ দিব। আর তারা তদনুযায়ী সৃষ্টির কাঠামোতে রদবদল করবে’ (নিসা ৪/১১৯)

এই রদবদল শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে বর্তমান যুগের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অন্যতম। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের নামে যারা সন্তান হত্যা বা অনাগত ভবিষ্যত বংশধরদের হত্যা করে চলেছে, তারা সন্তানের জন্মকেই দারিদ্রের কারণ বলে চিহ্নিত করেছে। আর সেজন্যেই ক্রমশঃ জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন নির্লজ্জভাবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জ্যামিতিক হারে হরাস পেয়েছে। ভবিষ্যৎ বংশধর উৎপাদন ব্যাহত হ’লে মানব জাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যার ফলশ্রুতিতে মুনাফা অর্জনের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী সক্রিয় হবে।

জাহেলী যুগে সন্তানের আধিক্য থেকে বাঁচার জন্য লোকেরা সন্তান প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করত। গর্ভ নিরোধের প্রাচীন ও আধুনিক যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে, সবগুলোই মানব বংশ ধ্বংসের পক্ষে কঠিন বিপদ বিশেষ। [24]

জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ইউরোপ তাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ বিবেচনা করেছে। [25] জন্মনিয়ন্ত্রণ জন্মহার হরাসের একমাত্র কারণ না হ’লেও অন্যতম প্রধান কারণ একথা নিশ্চিত। ইংল্যান্ডের রেজিষ্ট্রার জেনারেল নিজেই একথা স্বীকার করেছেন যে, জন্মহার হরাস পাওয়ার শতকরা ৭০ ভাগ জন্ম নিয়ন্ত্রণের দরুণ ঘটে থাকে। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকাতে বলা হয়েছে, পাশ্চাত্য দেশসমূহের জন্ম হার হরাস প্রাপ্তির কারণ গুলোর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম উপকরণাদির প্রভাব অত্যধিক। জন্মনিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবারকে সীমিত করার প্রবণতার কারণেই জন্মহার হরাস পাচ্ছে। [26]

ফ্রান্স সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় ও পদ্ধতিকে পরীক্ষা করেছে। একশত বছর পর সেখানে প্রতিটি যেলায় মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার কমে যেতে থাকে। আর এই জনসংখ্যার হার কমে যাওয়ার ফলে দু’টি বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করে যে, বিশ্বে তার প্রভাব প্রতিপত্তির সমাধি রচিত হয়। [27]

ফিডম্যান বলেন, সমষ্টিগতভাবে আমেরিকান শতকরা ৭০টি পরিবার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর বৃটেন ও আমেরিকার অবস্থা পর্যবেক্ষণে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পরিবারগুলোর ক্ষুদ্র আকার প্রাপ্তির মূলে রয়েছে জন্মনিরোধের প্রচেষ্টা। [28] যদি ম্যালথাস আজ জীবিত থাকতেন, তাহ’লে এটা নিশ্চয়ই অনুভব করতেন যে, পাশ্চাত্যের লোকেরা জন্ম নিরোধ করার ব্যাপারে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশী দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। পাশ্চাত্যের শিল্প ও নগর সভ্যতার কারণে অন্যান্য জাতিও বিপদের সম্মুখীন।

সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় :

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাতে ক্রমশঃ পারস্পরিক সদ্ভাব ও ভালবাসা হরাস এবং অবশেষে ঘৃণা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। তাছাড়া নারীদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যে বৈকল্য দেখা দেয় এবং তার মেজায দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠে, ফলে দাম্পত্য জীবনের সকল সুখ-শান্তি বিদায় নেয়। সন্তানই স্বামী-স্ত্রীকে চিরদিন একত্রে সংসার গঠনের ভূমিকা রাখে। এজন্য বলা যায়, সন্তানই পরিবার গঠনের সেঁতুবন্ধন।

ইউরোপ ও আমেরিকাতে দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং জন্মনিরোধ আন্দোলন প্রসারের সঙ্গে তালাকের সংখ্যাও দিন দিন দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে, সেখানে এখন দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। [29]

সমস্ত ইউরোপের সামাজিক দৃশ্যপট বদলে যায় শিল্প বিপ্লবের অভিঘাতে। আমূল পরিবর্তন আসে গ্রামীন জীবনেও, ভেঙ্গে যায় পারিবারিক জীবনের ভিত। নারীরা কল-কারখানায় নির্বিঘ্নে কাজ করতে শুরু করে। এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান তরুণ নিহত হ’ল। ফলে বিধবা হ’ল অগণিত নারী। যুদ্ধ বিড়ম্বিতা নারীরা বাধ্য হয়ে পুরুষের শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে কারখানা মালিকের নিকটে শ্রম বিক্রয়ের পাশাপাশি কমনীয় দেহটাও মনোরঞ্জনের জন্য দিতে হ’ল। যৌবনের তাড়নায় ইন্দ্রিয় ক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য তাকে বেছে নিতে হ’ল অবাধ বিচরণের পথ। আর নারীর মনের গভীরে পেটের ক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত হ’ল অতৃপ্ত যৌনতা এবং দামী পোশাক ও প্রসাধনীর প্রতি প্রচন্ড মোহ। [30]

জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে চরিত্রের ক্ষতি সাধিত হয়। এ ব্যবস্থা নারী-পুরুষের অবাধ ব্যভিচারের সনদ দিয়ে থাকে। কেননা এতে জারজ সন্তান গর্ভে ধারণ ও দুর্নাম রটনার ভয় থাকে না। এজন্য অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। Dr. Westr Marck তার বিখ্যাত গ্রন্থ Future of Marriage in Western Civilaization-এ বলেন, গর্ভনিরোধ বিদ্যা বিয়ের হার বাড়াতে পারে। কিন্তু এর ফলে বিয়ে বন্ধন ছাড়াই যৌন মিলনের পথও অত্যন্ত প্রশস্ত হয়ে যায়। [31]

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে শিশুরাও তাদের মেধা বিকাশে বাধাগ্রস্থ হয়। যদি অন্য ছোট-বড় ভাই বোন খেলার সাথী হিসাবে থাকে, তবে তাদের সাথে একত্রে থাকা ও মেলামেশা, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি শিক্ষণীয় গুণাবলী তার মাঝেও প্রস্ফুটিত হয়। মনস্তত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, একাকিত্বের ফলে শিশুদের মন-মগজের সুষ্ঠু বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। এমনকি দু’টি শিশুর বয়সের পার্থক্য বেশী হ’লে নিকটস্থ ছোট শিশু না থাকার কারণে বড় শিশুটির মস্তিষ্কে (Neurosisi) অনেক ক্ষেত্রে রোগও সৃষ্টি হয়। [32]

অর্থনৈতিক ক্ষতি :

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে নৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির পাশাপাশি এ সমস্ত উপকরণ ব্যবহারের জন্য জাতীয় রাজস্বে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়। এটাকে এক ধরনের অপচয় বললেও ভুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

‘তোমরা) অপব্যয় কর না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’ (ইসরা ১৭/২৭)

‘খাও ও পান কর, অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পসন্দ করে না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)

বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ জনসংখ্যা হরাস জনিত যুক্তি দিন দিন অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর কারণ হ’ল- জন্মহার ধারাবাহিকভাবে (Topering) কমে যাওয়ার ফলে একদিকে পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন হরাস পায়। পক্ষান্তরে বাড়তি জনসংখ্যার কারণে পুঁজি বিনিয়োগ ব্যবস্থা উন্নত হয়। [33] কেনসি হাসান বলেন, জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করলে সমাজের অর্থনৈতিক তৎপরতাও অনেক বেড়ে যায়। সে সময় সম্প্রসারণকারী শক্তিগুলি (Expansive) সংকোচনকারী শক্তিগুলির (Contractive) তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী হয়। তখন অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। আর জনসংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা হরাস পায়।

বাংলাদেশ অতি ছোট দেশ। এদেশের সামান্য আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশী। কিন্তু প্রতিবছর এদেশ শ্রমশক্তি বিদেশে রফতানী করে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। এই বিশাল জনসংখ্যা যদি শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়, তাহ’লে এ জনসংখ্যা ক্ষতির কারণ না হয়ে আশীর্বাদের কারণ হবে। যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশের রাজস্ব খাতে বিরাট ভূমিকা রাখছে, নিশ্চয়ই তা বেকারতব দূর করতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

অন্যথা ‘পরিবার পরিকল্পনার’ নামে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে জনশক্তির অপমৃত্যু, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবক্ষয়। এই জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় কনডম, ইনজেকশন, বড়ি ও খাবার পিল ইত্যাদি। সরকারের পক্ষ থেকে যে খাবার পিল বিতরণ করা হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। কিন্তু বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী যে পিল বের করেছে তা উচ্চ মূল্যে (৫০-৮০ টাকা) ক্রয় করে জনগণ ব্যবহার করছে। এতে পুঁজিবাদীরা জনগণের পকেট ফাঁকা করে চলেছে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে।

গ্রামাঞ্চলে একটি শিশুর জন্ম দানের জন্য এত টাকা ব্যয় করতে হয় না, যত টাকা ব্যয় করতে হয় জন্মনিরোধ উপকরণাদি ক্রয়ের জন্য। [34]

জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে শ্রমজীবী লোক দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার ফলে পুঁজিবাদীরা উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানী করে মিল-কারখানায় উৎপাদন করছে। এতে দ্রব্যমূল্য দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে জনসংখ্যা হরাস পাওয়ার ফলে পণ্যের ব্যবহারও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদনও কমে আসছে। অতএব জন্মনিয়ন্ত্রণ আমাদের কোন সুফল বয়ে আনেনি বরং অর্থনৈতিক ও নৈতিকতার মহা ক্ষতির কারণ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে এর বিধান :

মহান আল্লাহ পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করে আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। কিন্তু মাতা হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টির কোন প্রয়োজন ছিল কি? যদি একটু চিন্তা করি, তবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-এর একাকীত্ব দূর করতে জীবন সঙ্গিনী হিসাবে হাওয়া (আঃ)-কে শুধু সৃষ্টি করেননি। বরং আরও একটি বিশেষ কারণে তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। তাহ’ল মহান আল্লাহ তাদের ঔরশজাত সন্তান দ্বারা সমগ্র পৃথিবী কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিতে চেয়েছেন। আর সমস্ত মানব তাঁর (আল্লাহর) একত্ব ঘোষণা পূর্বক দাসত্ব করবে। এ হ’ল আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর সৃষ্টির একান্ত উদ্দেশ্য। আমরা সেই অনাগত সন্তানদের নির্বিঘ্নে হত্যা করে চলেছি। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

َوَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ

‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না দারিদ্রের কারণে, আমিই তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই রিযিক দান করব’ (আন‘আম ৬/১৫১)

আলোচ্য আয়াতে খাবারের অভাবের আশংকায় অনাগত সন্তানকে হত্যা করতে মহান আল্লাহ স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। আবার বললেন, ‘আমি তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই দিব’। ‘আমিই দিব’ এই প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যা হ’ল অনাগত সন্তানদের রিযিকের মালিক আল্লাহ। তাঁর খাদ্য ভান্ডারে খাবারের হিসাব অকল্পনীয়। আবার তিনি বললেন,

‘নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মারাত্মক ভুল’ (ইসরা ১৭/৩১)

তিনি যথার্থই বলেছেন, অনাগত সন্তান হত্যা করা বিরাট ভুল। ভূপৃষ্ঠে একচতুর্থাংশ স্থল, বাকী সব সাগর, মহাসাগর। কিন্তু বর্তমানে মহাসাগরে হাওয়াইন দ্বীপপুঞ্জের মত ছোট-বড় দ্বীপ জেগে উঠেছে এবং নদী ভরাট হয়ে চর জেগে উঠেছে। এভাবে আমাদের আবাদী জমি ও বাসস্থান বাড়ছে এতে কোন সন্দেহ নেই।

মহান আল্লাহ বলেন,

‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন’ (কাহাফ ১৮/৪৬)

আল্লামা আলুসী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ধন-সম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায়। আর সন্তান হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার মাধ্যম। [35]

জনৈক রুশ লেখক তার Biological Tragedy of Woman গ্রন্থে বলেছেন, নারী জন্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানববংশ রক্ষা করা। [36] যৌন প্রেরণার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য মানববংশ বৃদ্ধির সঙ্গে দেহের প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে তৎপর। নারী দেহের বৃহত্তম অংশ গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মানোর উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট। [37] মা হাওয়াসহ পৃথিবীর সমস্ত নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য মানব বংশ রক্ষা ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে পারিবারিক কাঠামোতে সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালন।
আযল-এর বিধান :

প্রাচীনকালে আরব সমাজে ‘আযল’ করার যে প্রচলন ছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কোন আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে হাদীছে স্পষ্ট আলোচনা আছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল-

১. জাবির (রাঃ) বলেন,

كُنَّا نَعْزِلُ وَالْقُرْآنُ يَنْزِلُ

‘আমরা রাসূলের জীবদ্দশায় ‘আযল’ করতাম অথচ তখনও কুরআন নাযিল হচ্ছিল। [38]

অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে ‘আযল’ সম্পর্কে কোন নিষেধবাণী আসেনি। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তা নিষেধ করেননি।

وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَزْوَةِ بَنِي الْمُصْطَلِقِ فَأَصَبْنَا سَبْيًا مِنْ سَبْيِ الْعَرَب فاشتهينا النِّسَاء واشتدت عَلَيْنَا الْعُزْبَةُ وَأَحْبَبْنَا الْعَزْلَ فَأَرَدْنَا أَنْ نَعْزِلَ وَقُلْنَا: نَعْزِلُ وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ أَظْهُرِنَا قَبْلَ أَنْ نَسْأَلَهُ؟ فَسَأَلْنَاهُ عَن ذَلِك فَقَالَ: مَا عَلَيْكُمْ أَلاَّ تَفْعَلُوْا مَا مِنْ نَسَمَةٍ كَائِنَةٍ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ إِلاَّ وَهِيَ كَائِنَةٌ-

২. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,

আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে বনী মুস্তালিকের যুদ্ধে বের হয়ে গেলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক আরবকে (দাসী) বন্দী করে নিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রমণীদের প্রতি আকর্ষণ জাগে। যৌন ক্ষুধাও তীব্র হয়ে উঠে এবং এ অবস্থায় ‘আযল করাকেই আমরা ভাল মনে করলাম। তখন এ সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জবাবে বললেন, তোমরা যদি তা কর তাতে তোমাদের ক্ষতি কি? কেননা আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি করবেন, তা তিনি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন এবং তা অবশ্যই সৃষ্টি করবেন। [39]

৩. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

তুমি কি সৃষ্টি কর? তুমি কি রিযিক দাও? তাকে তার আসল স্থানেই রাখ, সঠিকভাবে তাকে থাকতে দাও। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়ছালা রয়েছে। [40]

ইবনে সীরীন-এর মতে, لاعليكم ان لاتفعلوا এ বাক্যে ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ না থাকলেও এ যে নিষেধের একেবারে কাছাকাছি এতে কোন সন্দেহ নেই। [41]

হাসান বছরী বলেন, আল্লাহর শপথ, রাসূলের একথায় ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট ভৎর্সনা ও হুমকি রয়েছে। [42]

ইমাম কুরতুবী বলেছেন, ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত কথা থেকে নিষেধই বুঝেছিলেন। ফলে এর অর্থ দাঁড়ায় রাসূল (ছাঃ) যেন বলেছেন, لاتعزلوا وعليكم ان لاتفعلوا তোমরা ‘আযল’ কর না, তা না করাই তোমাদের কর্তব্য। [43]

রাগিব ইসফাহানীর মতে, ‘আযল’ করে শুক্র বিনষ্ট করা এবং তাকে তার আসল স্থানে নিক্ষেপ না করা সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ। [44]

মুয়াত্তা গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন যে, ইবনে ওমর (রাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম যাঁরা ‘আযল’ পসন্দ করতেন না। [45]

عزل অর্থ হ’ল, পুরুষাঙ্গ স্ত্রী অঙ্গের ভেতর থেকে বের করে নেয়া যেন শুক্র স্ত্রী অঙ্গের ভেতরে স্খলিত হওয়ার পরিবর্তে বাইরে স্খলিত হয়।[46]

আইয়ামে জাহেলিয়াতে যেসব কারণে সন্তান হত্যা করা হ’ত, বর্তমান যামানায় জন্মনিয়ন্ত্রণও ঠিক একই কারণে গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সোনালী যুগের ‘আযল’-এর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে যুগে তিনটি কারণে মুসলমানদের মধ্যে ‘আযল’-এর প্রচলন ছিল।

(এক) দাসীর গর্ভে নিজের কোন সন্তান জন্মানো তাঁরা পসন্দ করতেন না, সামাজিক হীনতার কারণে।

(দুই) দাসীর গর্ভে কারো সন্তান জন্মালে উক্ত সন্তানের মাকে হস্তান্তর করা যাবে না, অথচ স্থায়ীভাবে দাসীকে নিজের কাছে রেখে দিতেও তারা প্রস্ত্তত ছিল না।

(তিন) দুগ্ধপায়ী শিশুর মা পুনরায় গর্ভ ধারণ করার ফলে প্রথম শিশুর স্বাস্থ্যহানীর আশংকা অথবা পুনরায় সন্তান গর্ভে ধারণ করলে মায়ের স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের আশংকা, কিংবা সন্তান প্রসবের কষ্ট সহ্য করার অনুপযুক্ত তা চিকিৎসকের পরামর্শে যথাযোগ্য বিবেচনায় এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

উপরোক্ত তিনটি কারণের মধ্যে প্রথম দু’টি কারণ আধুনিক যুগে বিলুপ্ত হয়েছে। শেষের তিন নম্বর কারণ ব্যতিরেকে সম্পদ সাশ্রয়ের জন্য ও নিজের আমোদ-প্রমোদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করা বৈধ নয়।

পরিশেষে বলব, জন্মনিয়ন্ত্রণ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সমস্যার প্রকৃত সমাধান নয়। বরং জনসংখ্যাকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর ও উৎপাদন বাড়ানো, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপকরণাদির উন্নয়ণের মধ্যেই রয়েছে এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থ হচ্ছে না বুঝে পরাজয় বরণ করা। একটি কাপড় কারো শরীরে ঠিকমত ফিট না হ’লে কাপড়টি বড় করার পরিবর্তে মানুষটির শরীর কেটে ছেঁটে ছোট করার মতই জন্মনিরোধ ব্যবস্থা অন্যায় ও অস্বাভাবিক। কেননা বিজ্ঞানের যুগে আমরা মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী তার শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!!


[1] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৯২), পৃঃ ১৩-১৫।
[2] . ডা. এস.এন. পান্ডে, গাইনিকলজি শিক্ষা, (কলিকাতা : আদিত্য প্রকাশনী, ১৯৭৭), পৃঃ ১২৪।
[3] . ঐ, পৃঃ ১২৫।
[4] . ঐ, পৃঃ ১৪।
[5] . Sehwarz Oswald, The Psycology of Sex (London : 1951), P. 50.
[6] . Cheser Is Chastity Outmoded, (Londen : 1960), P. 75.
[7] . নারী ৯৭ পৃঃ; হাফেয মাসঊদ আহমদ; আত-তাহরীক (বিশ্বে বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজে নারী : একটি সমীক্ষা-) (৬ষ্ঠ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা জানুয়ারী ২০০৩), পৃঃ ৪
[8] . George Lindsey, Revolt of Modern Youth P-82-83.
[9] . দৈনিক ইনকিলাব, ৬ই জুন ১৯৯৮ ইং।
[10] . মাসিক পৃথিবী (প্রশ্চাত্যে যৌন বিকৃতি, জুলাই ২০০১ইং, পৃঃ ৫২-৫৩।
[11] . জহুরী খবরের খবর, ১ খন্ড, ১১৬ পৃঃ।
[12] . মরিয়ম জামিলা, ইসলাম ও আধুনিকতা, ৯৯ পৃঃ।
[13] . খবরের খবর, ১ম খন্ড, ১১৬ পৃঃ।
[14] . সায়্যেদ কুতুব, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, ৯৮ পৃঃ।
[15] . দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ এপ্রিল ২০১১, পৃঃ ৫।
[16] . নারী, পৃঃ ৮৫; আত-তাহরীক, জানুয়ারী ২০০৩, পৃঃ ৪।
[17] . ইসলাম ও আধুনিকত, পৃঃ ২৩।
[18] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬২।
[19] . Her self, Dr. Lowry, P-204.
[20] . কারেন্ট নিউজ (ডিসেম্বর সংখ্যা ২০০১), পৃঃ ১৯।
[21] . The New Straits Jimes, (Kualalampur, Malaysia, 23 june 1988), P-9.
[22] . প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১০, পৃঃ ৪।
[23] . গাইনিকলজি শিক্ষা, পৃঃ ১২৩।
[24] . মাওলানা আব্দুর রহিম, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২।
[25] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১২৮।
[26] . Report of the Royal Commission on population (1949), P-34.
[27] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১১২।
[28] . Family Planning Sterility and Population Growth (Newyork : 1959), P-5.
[29] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৮-৬৯।
[30] . ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, পৃঃ ৯৮-১০১।
[31] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৯।
[32] . David M Levy, Maternal Over Protiction- (Newyork : 1943), P-35.
[33] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৭৩।
[34] . British Medical Journal, (London : 8 July, 1961), P-120.
[35] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৪০।
[36] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৫৮।
[37] . The Psychology of Sex, P-17.
[38] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৪।
[39] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৬।
[40] . সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৭৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪০৩৮।
[41] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩৩।
[42] . ঐ।
[43] . ঐ।
[44] . ঐ, পৃঃ ৩৩৭।
[45] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১০১-১০২।
[46] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২।

জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও ইসলামের বিধান – Family planning in Islam-Bangla

জন্ম নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের পটভূমি :

জন্ম নিয়ন্ত্রণ (Birth control) আন্দোলন আঠারো শতকের শেষাংশে ইউরোপে সূচনা হয়। সম্ভবত: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসই (Malthus) এর ভিত্তি রচনা করেন। এ আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য হ’ল বংশ বৃদ্ধি প্রতিরোধ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার দেখে মি. ম্যালথাস হিসাব করেন, পৃথিবীতে আবাদযোগ্য জমি ও অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান সীমিত। কিন্তু বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমাহীন। ১৭৯৮ সালে মি. ম্যালথাস রচিত An essay on population and as it effects, the future improvment of the society. (জনসংখ্যা ও সমাজের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে এর প্রভাব) নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম তার মতবাদ প্রচার করেন। এরপর ফ্র্যান্সিস প্ল্যাস (Francis Place) ফরাসী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার প্রতি জোর প্রচারণা চালান। কিন্তু তিনি নৈতিক উপায় বাদ দিয়ে ঔষধ ও যন্ত্রাদির সাহায্যে গর্ভনিরোধ করার প্রস্তাব দেন। আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার চার্লস নোল্টন (Charles knowlton) ১৮৩৩ সালে এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন সূচক উক্তি করেন। তিনি তার রচিত The Fruits of philosophy নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধের চিকিৎসা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং এর উপকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

কিন্তু মাঝখানে ১৮৪০ সাল থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন বন্ধ থাকে। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা এর প্রতি কোনরূপ গুরুত্বারোপ ও সহযোগিতা করতে অস্বীকার জানিয়েছিলেন।

আবার ১৮৭৬ সালে নতুন করে ম্যালথাসীয় আন্দোলন (New Malthusian Movment) নামক নতুন আন্দোলন শুরু হয়। মিসেস এ্যানী বাসন্ত ও চার্লস ব্রাডার ডাঃ নোল্টনের (Fruits of philosophy) গ্রন্থটি ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ডাঃ ড্রাইসডেল (Drysdale)-এর সভাপতিত্বে একটি সমিতি গঠিত হয় ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচার কার্য শুরু হয়ে যায়।

১৮৭৯ সালে মিসেস বাসন্ত-এর রচিত Law of population (জনসংখ্যার আইন) নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ সালে হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানীতে এ আন্দোলন ছড়িয়ে যায় এবং ক্রমে ইউরোপ ও আমেরিকার সকল সভ্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানে স্থানে জন্মনিরোধ ক্লিনিক (Birth Control Clinics) খুলে দেয়। [1]

বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে প্রকাশ্যে সন্তান হত্যার হিড়িক পড়ে গেছে। এমনকি দৈনিক পত্রিকাসহ সকল মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচারণা চলছে। যেমন ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট’, দুইটি সন্তানের বেশী নয়, একটি হ’লে ভালো হয়’ ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু স্যাটেলাইট ক্লিনিক গর্ভবর্তী মায়ের সেবার নামে গর্ভপাত ঘটানোর গ্যারেজে পরিণত হয়েছে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি :

জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি দু’প্রকার : (১) সাময়িক ব্যবস্থা ও (২) স্থায়ী ব্যবস্থা।

(১) সাময়িক ব্যবস্থা :

(ক) আযল তথা ভিতরে বীর্যপাত না করা (With drawal)

(খ) নিরাপদ সময় মেনে চলা (Safe period) ।

(গ) কনডম ব্যবহার। (ঘ) ইনজেকশন পুশ। (ঙ) পেশীতে বড়ী ব্যবহার। (চ) মুখে পিল সেবন ইত্যাদি।

(২) স্থায়ী ব্যবস্থা :

(ক) পুরুষের অপারেশন। (খ) নারীর অপারেশন।

(ক) পুরুষের অপারেশন : পুরুষের অন্ডকোষে উৎপাদিত শুক্রকীটবাহী নালী (Vas deferens) দু’টি কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে, কিন্তু বীর্যে xy ক্রমোজম শুক্রকীট না থাকায় সন্তান হয় না। [2]

(খ) নারীর অপারেশন : নারীর ডিম্বাশয়ে উৎপাদিত ডিম্ববাহী নালী (Fallopian Tube কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পূর্ণ xx ক্রমোজম ডিম্ব (Matured Ovum) আর জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে না। [3]

নারী অথবা পুরুষে যেকোন একজন স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, অপর জনকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় না। কারণ নারীর ডিম্ব পুরুষের শুক্রকীট দ্বারা নিষিক্ত না হ’লে সন্তানের জন্ম হয় না। [4]
জন্ম নিয়ন্ত্রণের কুফল :

জন্মনিয়ন্ত্রণের বহুবিদ কুফল রয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল-

ব্যাভিচারের প্রসার :

ব্যাভিচার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَّسَاءَ سَبِيْلاً

‘তোমরা অবৈধ যৌন সম্ভোগের নিকটবর্তী হয়ো না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ’ (ইসরা ১৭/৩২)

কিন্তু শয়তান মানুষকে দরিদ্রতার ভয় দেখিয়ে অসামাজিক, অনৈতিক কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে। নারী জাতি আল্লাহভীতির পাশাপাশি আরও একটি নৈতিকতা রক্ষা করতে বাধ্য হয়। তাহ’ল অবৈধ সন্তান জন্মের ফলে সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট হবার আশংকা। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়ার ফলে, এ আশংকা থেকে একদম মুক্ত। যারা নৈশক্লাবে নাচ-গান করে, পতিতা বৃত্তি করে, প্রেমের নামে রঙ্গলীলায় মেতে উঠে, তারা অবৈধ সন্তান জন্মানোর আশংকা করে না। তাছাড়া কখনও হিসাব নিকাশে গড়মিল হয়ে অবৈধ সন্তান যদিও গর্ভে এসে যায়, তবে স্যাটেলাইট ক্লিনিক নামের সন্তান হত্যার গ্যারেজে গিয়ে প্রকাশ্যে গর্ভ নষ্ট করে ফেলে।

ইংল্যান্ডে প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৮৬ জন নারী বিয়ে ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। অবৈধ সন্তান জন্মের সময় এদের শতকরা ৪০ জন নারীর বয়স ১৮-১৯ বছর, ৩০ জন নারীর বয়স ২০ বছর এবং ২০ জন নারীর বয়স ২১ বছর। এরা তারাই যারা জন্মনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরও এ দুর্ঘটনাবশত গর্ভবতী হয়েছিল। [5] সেখানে প্রতি তিন জন নারীর একজন বিয়ের পূর্বে সতীত্ব সম্পদ হারিয়ে বসে। ডাঃ চেসার তার রচিত ‘সতীত্ব কি অতীতের স্মৃতি?’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছেন’। [6]

Indian Council for Medical Research-এর ডিরেক্টর জেনারেল অবতার সিংহ পেইন্টাল বলেন, We used to think our women were chaste, But people would be horrified at the level of promise culty here. অর্থাৎ আমাদের নারীদেরকে আমরা সতী বলে মনে করতাম। কিন্তু অবৈধ যৌনকর্ম এখানে এতবেশী বৃদ্ধি পেয়েছে যে, লোকে এতে ভীত না হয়ে পারে না। [7]

আমেরিকার বিদ্যালয় সমূহে অশ্লীল সাহিত্যের চাহিদা সর্বাপেক্ষা বেশী। যুবক-যুবতীরা এসব অধ্যয়ন করে অশালীন কাজে লিপ্ত হয়। এছাড়া হাইস্কুলের শতকরা ৪৫ জন ছাত্রী স্কুল ত্যাগ করার পূর্বে চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। আর এদের যৌন তৃষ্ণা অনেক বেশী। [8] বৃটেনেও শতকরা ৮৬ জন যুবতী বিয়ের সময় কুমারী থাকে না। [9] প্রাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে তাদের শিক্ষা ব্যয়ের প্রায় অধিকাংশ খন্ডকালীন যৌনকর্মী হিসাবে অর্জন করে থাকে। মঙ্গোলয়েড দেশসমূহে যৌন সম্পর্কীয় বিধি-বিধান অত্যন্ত শিথিল। থাইল্যান্ডের ছাত্রীদের বিপুল যৌনতা লক্ষ্য করা যায়। [10]

চীনের ক্যান্টন শহরে কুমারীদের প্রেম বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য বিদ্যালয় খোলা হয়েছে। [11] পশ্চিমা সভ্যতার পূজারীরা সর্বজনীন অবৈধ যৌন সম্পর্কের মহামারীর পথ প্রশস্ত করেছে। [12] চীনে যৌন স্বাধীনতার দাবী সম্বলিত পোষ্টারে যার সাথে খুশী যৌন মিলনে কুণ্ঠিত না হবার আহবান জানানো হয়। [13] ইউরোপে যৌন স্বাধীনতার দাবীতে পুরুষের মত নারীরাও নৈতিকতা হারিয়ে উচ্ছৃংখল ও অনাচারী এবং সুযোগ পেলেই হন্যে হয়ে তৃপ্ত করত যৌনক্ষুধা। অশুভ এই প্রবণতার ফলে বৈবাহিক জীবন ও পরিবারের প্রতি চরম অনিহা সৃষ্টি হয়। [14] অর্থ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে আমেরিকার ৭৫ লাখ নারী পুরুষ বিবাহ ব্যতীত ‘লিভ টুগেদার’-এ। [15]

প্রাশ্চাত্যের যুবতীরা যাতে অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভবতী না হয়ে পড়ে, সেজন্য তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে গর্ভনিরোধের দ্রব্যাদি দেয়া হয় এবং এ সকল দ্রব্য ব্যবহারের বিষয়ে তাদেরকে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়ে থাকে। এমনকি মায়েরা কন্যাদেরকে এই সকল দ্রব্য ব্যবহারের কায়দা-কৌশল শিক্ষা দিয়ে থাকে। গর্ভনিরোধ দ্রব্যাদির ব্যবহার সম্পর্কে স্কুল-কলেজে প্রচারপত্র বের করে এবং বিশেষ কোর্সেরও প্রবর্তন করে। এর অর্থ হ’ল- সকলেই নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছে যে, যুবক-যুবতীরা অবৈধ যৌন সম্ভোগ করবেই। [16]

প্রাশ্চাত্যে ক্রমবর্ধমান অবৈধ যৌন স্বাধীনতাই সবচাইতে ক্ষতি সাধন করেছে। নারীর দেহকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়ার কোন প্রচেষ্টাই বাকী রাখা হয়নি। অবিবাহিত মহিলাদের গর্ভধারণের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবৈধ সন্তান জন্ম, গর্ভপাত, তালাক, যৌন অপরাধ ও যৌন ব্যাধিই এর প্রমাণ। অপর দিকে অবৈধ যৌন সম্পর্কের ফলে কোন আইন-বিচার ও আইনী শাস্তির বিধান নেই। বরং এটাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিবেচনা করা হয়। [17]

সম্প্রতি ভারতেও অবৈধ যৌন সম্প্রীতি ও হিন্দু-মুসলমান যুবক-যুবতীর নির্বিঘ্নে বিবাহ বন্ধন এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের নামে গর্ভপাত ঘটানোর হিড়িক পড়ে গেছে।

জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব :

নারীর ব্যাভিচার দিনদিন প্রসার লাভ করে চলেছে। নারী স্বাধীনতার নামে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। এই অবৈধ যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মারাত্মক জটিল সব রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জীবাণু নাশক ঔষধ, পিল, কনডম ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহারের ফলে তৎক্ষণা কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু বেশ কিছু কাল যাবৎ এসব ব্যবহার করার ফলে মধ্যবর্তী বয়সে উপনীত হ’তে না হ’তেই নারী দেহের স্নায়ুতন্ত্রীতে বিশৃংখলা (Nervous instability) দেখা দেয়। যেমন- নিস্তেজ অবস্থা, নিরানন্দ, উদাসীনতা, রুক্ষমেজায, বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতা, মস্তিষ্কের দুর্বলতা, হাত-পা অবশ, শরীরে ব্যথা, স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, ক্যান্সার, অনিয়মিত ঋতু, সৌন্দর্য নষ্ট ইত্যাদি। [18] নারী-পুরুষ অবৈধ যৌন মিলনে সিফিলিস, প্রমেহ, গণরিয়া, এমনকি এইডস-এর মত মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যে সমস্ত বিবাহিতা নারীর দেহে অস্ত্রপচার করা হয়, তাদের শতকরা ৭৫ জনের মধ্যেই সিফিলিসের জীবাণু পাওয়া যায়। [19]

সিফিলিস রোগে আক্রান্ত রোগী সুচিকিৎসা গ্রহণ না করলে মারাত্মক সব রোগের সৃষ্টি হয়। এইডস রোগের ভাইরাসের নাম এইচ. আই. ভি (HIV)। এ ভাইরাস রক্তের শ্বেত কণিকা ধ্বংস করে। এ রোগ ১৯৮১ সালে প্রথম ধরা পড়ে এবং ১৯৮৩ সালে একজন ফরাসী বিজ্ঞানী এইচ. আই. ভি ভাইরাসকে এই রোগের কারণ হিসাবে দায়ী করেন। [20] বল্গাহীন ব্যাভিচারের ফলে এই রোগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ডাঃ হিরোশী নাকজিমা বলেন, জনসাধারণের মধ্যে এইডস বিস্তার লাভ করলে সমগ্র মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। [21]

এছাড়া জন্ম নিরোধ পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে নানা প্রকার রোগ বদঅভ্যাসের প্রসার ঘটেছে। তন্মধ্যে কনডম ব্যবহার বা আযল করার জন্য নারীরা মিলনে পরিতৃপ্ত না হ’তে পেরে অবৈধ মিলনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, স্তনচাকা বা পিন্ড, স্তন ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে স্তনে এ ধরনের ব্যথা ও পিন্ড তৈরী হয় এবং ৭৫% নারী স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে। [22] বুক ও জরায়ুর কার্সিনোমা হ’তে পারে শর্করা জাতীয় খাদ্য সহ্য হয় না, লিভার দুর্বল হয়, রক্ত জমাট বাঁধতে ব্যহত হয়, বুকের দুধ কমে যায় এবং Lactation কম হয় এবং দেহে ফ্যাট জমা হয়। [23] এছাড়া জরায়ু ক্যান্সার ও স্থানচ্যুতি সহ আরও অনেক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জন্মের হার কমে যাওয়া :

আগত ও অনাগত সন্তান হত্যার ব্যাপারে মহান আল্লাহ নিষেধ করেন

وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاَقٍ

‘তোমরা অভাব ও দরিদ্রতার আশংকায় তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না’(ইসরা ১৭/৩১)

কিন্তু শয়তান আল্লাহর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলল,

وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آذَانَ الأَنْعَامِ وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللّهِ

‘আমি অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ দিব। আর তারা তদনুযায়ী সৃষ্টির কাঠামোতে রদবদল করবে’ (নিসা ৪/১১৯)

এই রদবদল শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে বর্তমান যুগের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অন্যতম। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের নামে যারা সন্তান হত্যা বা অনাগত ভবিষ্যত বংশধরদের হত্যা করে চলেছে, তারা সন্তানের জন্মকেই দারিদ্রের কারণ বলে চিহ্নিত করেছে। আর সেজন্যেই ক্রমশঃ জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন নির্লজ্জভাবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জ্যামিতিক হারে হরাস পেয়েছে। ভবিষ্যৎ বংশধর উৎপাদন ব্যাহত হ’লে মানব জাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যার ফলশ্রুতিতে মুনাফা অর্জনের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী সক্রিয় হবে।

জাহেলী যুগে সন্তানের আধিক্য থেকে বাঁচার জন্য লোকেরা সন্তান প্রসবের সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করত। গর্ভ নিরোধের প্রাচীন ও আধুনিক যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে, সবগুলোই মানব বংশ ধ্বংসের পক্ষে কঠিন বিপদ বিশেষ। [24]

জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ইউরোপ তাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ বিবেচনা করেছে। [25] জন্মনিয়ন্ত্রণ জন্মহার হরাসের একমাত্র কারণ না হ’লেও অন্যতম প্রধান কারণ একথা নিশ্চিত। ইংল্যান্ডের রেজিষ্ট্রার জেনারেল নিজেই একথা স্বীকার করেছেন যে, জন্মহার হরাস পাওয়ার শতকরা ৭০ ভাগ জন্ম নিয়ন্ত্রণের দরুণ ঘটে থাকে। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকাতে বলা হয়েছে, পাশ্চাত্য দেশসমূহের জন্ম হার হরাস প্রাপ্তির কারণ গুলোর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম উপকরণাদির প্রভাব অত্যধিক। জন্মনিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবারকে সীমিত করার প্রবণতার কারণেই জন্মহার হরাস পাচ্ছে। [26]

ফ্রান্স সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় ও পদ্ধতিকে পরীক্ষা করেছে। একশত বছর পর সেখানে প্রতিটি যেলায় মৃত্যুহারের চেয়ে জন্মহার কমে যেতে থাকে। আর এই জনসংখ্যার হার কমে যাওয়ার ফলে দু’টি বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করে যে, বিশ্বে তার প্রভাব প্রতিপত্তির সমাধি রচিত হয়। [27]

ফিডম্যান বলেন, সমষ্টিগতভাবে আমেরিকান শতকরা ৭০টি পরিবার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর বৃটেন ও আমেরিকার অবস্থা পর্যবেক্ষণে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পরিবারগুলোর ক্ষুদ্র আকার প্রাপ্তির মূলে রয়েছে জন্মনিরোধের প্রচেষ্টা। [28] যদি ম্যালথাস আজ জীবিত থাকতেন, তাহ’লে এটা নিশ্চয়ই অনুভব করতেন যে, পাশ্চাত্যের লোকেরা জন্ম নিরোধ করার ব্যাপারে প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশী দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছে। পাশ্চাত্যের শিল্প ও নগর সভ্যতার কারণে অন্যান্য জাতিও বিপদের সম্মুখীন।

সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় :

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাতে ক্রমশঃ পারস্পরিক সদ্ভাব ও ভালবাসা হরাস এবং অবশেষে ঘৃণা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। তাছাড়া নারীদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যে বৈকল্য দেখা দেয় এবং তার মেজায দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠে, ফলে দাম্পত্য জীবনের সকল সুখ-শান্তি বিদায় নেয়। সন্তানই স্বামী-স্ত্রীকে চিরদিন একত্রে সংসার গঠনের ভূমিকা রাখে। এজন্য বলা যায়, সন্তানই পরিবার গঠনের সেঁতুবন্ধন।

ইউরোপ ও আমেরিকাতে দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং জন্মনিরোধ আন্দোলন প্রসারের সঙ্গে তালাকের সংখ্যাও দিন দিন দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে, সেখানে এখন দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। [29]

সমস্ত ইউরোপের সামাজিক দৃশ্যপট বদলে যায় শিল্প বিপ্লবের অভিঘাতে। আমূল পরিবর্তন আসে গ্রামীন জীবনেও, ভেঙ্গে যায় পারিবারিক জীবনের ভিত। নারীরা কল-কারখানায় নির্বিঘ্নে কাজ করতে শুরু করে। এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান তরুণ নিহত হ’ল। ফলে বিধবা হ’ল অগণিত নারী। যুদ্ধ বিড়ম্বিতা নারীরা বাধ্য হয়ে পুরুষের শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়ে কারখানা মালিকের নিকটে শ্রম বিক্রয়ের পাশাপাশি কমনীয় দেহটাও মনোরঞ্জনের জন্য দিতে হ’ল। যৌবনের তাড়নায় ইন্দ্রিয় ক্ষুধা চরিতার্থ করার জন্য তাকে বেছে নিতে হ’ল অবাধ বিচরণের পথ। আর নারীর মনের গভীরে পেটের ক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত হ’ল অতৃপ্ত যৌনতা এবং দামী পোশাক ও প্রসাধনীর প্রতি প্রচন্ড মোহ। [30]

জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে চরিত্রের ক্ষতি সাধিত হয়। এ ব্যবস্থা নারী-পুরুষের অবাধ ব্যভিচারের সনদ দিয়ে থাকে। কেননা এতে জারজ সন্তান গর্ভে ধারণ ও দুর্নাম রটনার ভয় থাকে না। এজন্য অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। Dr. Westr Marck তার বিখ্যাত গ্রন্থ Future of Marriage in Western Civilaization-এ বলেন, গর্ভনিরোধ বিদ্যা বিয়ের হার বাড়াতে পারে। কিন্তু এর ফলে বিয়ে বন্ধন ছাড়াই যৌন মিলনের পথও অত্যন্ত প্রশস্ত হয়ে যায়। [31]

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে শিশুরাও তাদের মেধা বিকাশে বাধাগ্রস্থ হয়। যদি অন্য ছোট-বড় ভাই বোন খেলার সাথী হিসাবে থাকে, তবে তাদের সাথে একত্রে থাকা ও মেলামেশা, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি শিক্ষণীয় গুণাবলী তার মাঝেও প্রস্ফুটিত হয়। মনস্তত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, একাকিত্বের ফলে শিশুদের মন-মগজের সুষ্ঠু বিকাশে বাধা সৃষ্টি হয়। এমনকি দু’টি শিশুর বয়সের পার্থক্য বেশী হ’লে নিকটস্থ ছোট শিশু না থাকার কারণে বড় শিশুটির মস্তিষ্কে (Neurosisi) অনেক ক্ষেত্রে রোগও সৃষ্টি হয়। [32]

অর্থনৈতিক ক্ষতি :

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে নৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির পাশাপাশি এ সমস্ত উপকরণ ব্যবহারের জন্য জাতীয় রাজস্বে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়। এটাকে এক ধরনের অপচয় বললেও ভুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

‘তোমরা) অপব্যয় কর না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই’ (ইসরা ১৭/২৭)

‘খাও ও পান কর, অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পসন্দ করে না’ (আ‘রাফ ৭/৩১)

বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ জনসংখ্যা হরাস জনিত যুক্তি দিন দিন অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর কারণ হ’ল- জন্মহার ধারাবাহিকভাবে (Topering) কমে যাওয়ার ফলে একদিকে পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন হরাস পায়। পক্ষান্তরে বাড়তি জনসংখ্যার কারণে পুঁজি বিনিয়োগ ব্যবস্থা উন্নত হয়। [33] কেনসি হাসান বলেন, জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করলে সমাজের অর্থনৈতিক তৎপরতাও অনেক বেড়ে যায়। সে সময় সম্প্রসারণকারী শক্তিগুলি (Expansive) সংকোচনকারী শক্তিগুলির (Contractive) তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী হয়। তখন অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বেড়ে যায়। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। আর জনসংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে অর্থনৈতিক তৎপরতা হরাস পায়।

বাংলাদেশ অতি ছোট দেশ। এদেশের সামান্য আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশী। কিন্তু প্রতিবছর এদেশ শ্রমশক্তি বিদেশে রফতানী করে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। এই বিশাল জনসংখ্যা যদি শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়, তাহ’লে এ জনসংখ্যা ক্ষতির কারণ না হয়ে আশীর্বাদের কারণ হবে। যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশের রাজস্ব খাতে বিরাট ভূমিকা রাখছে, নিশ্চয়ই তা বেকারতব দূর করতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

অন্যথা ‘পরিবার পরিকল্পনার’ নামে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে জনশক্তির অপমৃত্যু, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবক্ষয়। এই জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় কনডম, ইনজেকশন, বড়ি ও খাবার পিল ইত্যাদি। সরকারের পক্ষ থেকে যে খাবার পিল বিতরণ করা হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। কিন্তু বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী যে পিল বের করেছে তা উচ্চ মূল্যে (৫০-৮০ টাকা) ক্রয় করে জনগণ ব্যবহার করছে। এতে পুঁজিবাদীরা জনগণের পকেট ফাঁকা করে চলেছে জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে।

গ্রামাঞ্চলে একটি শিশুর জন্ম দানের জন্য এত টাকা ব্যয় করতে হয় না, যত টাকা ব্যয় করতে হয় জন্মনিরোধ উপকরণাদি ক্রয়ের জন্য। [34]

জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে শ্রমজীবী লোক দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার ফলে পুঁজিবাদীরা উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানী করে মিল-কারখানায় উৎপাদন করছে। এতে দ্রব্যমূল্য দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে জনসংখ্যা হরাস পাওয়ার ফলে পণ্যের ব্যবহারও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদনও কমে আসছে। অতএব জন্মনিয়ন্ত্রণ আমাদের কোন সুফল বয়ে আনেনি বরং অর্থনৈতিক ও নৈতিকতার মহা ক্ষতির কারণ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে এর বিধান :

মহান আল্লাহ পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করে আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। কিন্তু মাতা হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টির কোন প্রয়োজন ছিল কি? যদি একটু চিন্তা করি, তবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-এর একাকীত্ব দূর করতে জীবন সঙ্গিনী হিসাবে হাওয়া (আঃ)-কে শুধু সৃষ্টি করেননি। বরং আরও একটি বিশেষ কারণে তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। তাহ’ল মহান আল্লাহ তাদের ঔরশজাত সন্তান দ্বারা সমগ্র পৃথিবী কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিতে চেয়েছেন। আর সমস্ত মানব তাঁর (আল্লাহর) একত্ব ঘোষণা পূর্বক দাসত্ব করবে। এ হ’ল আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর সৃষ্টির একান্ত উদ্দেশ্য। আমরা সেই অনাগত সন্তানদের নির্বিঘ্নে হত্যা করে চলেছি। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

َوَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ

‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না দারিদ্রের কারণে, আমিই তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই রিযিক দান করব’ (আন‘আম ৬/১৫১)

আলোচ্য আয়াতে খাবারের অভাবের আশংকায় অনাগত সন্তানকে হত্যা করতে মহান আল্লাহ স্পষ্ট নিষেধ করেছেন। আবার বললেন, ‘আমি তোমাদের রিযিক দান করি এবং তাদেরও আমিই দিব’। ‘আমিই দিব’ এই প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যা হ’ল অনাগত সন্তানদের রিযিকের মালিক আল্লাহ। তাঁর খাদ্য ভান্ডারে খাবারের হিসাব অকল্পনীয়। আবার তিনি বললেন,

‘নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মারাত্মক ভুল’ (ইসরা ১৭/৩১)

তিনি যথার্থই বলেছেন, অনাগত সন্তান হত্যা করা বিরাট ভুল। ভূপৃষ্ঠে একচতুর্থাংশ স্থল, বাকী সব সাগর, মহাসাগর। কিন্তু বর্তমানে মহাসাগরে হাওয়াইন দ্বীপপুঞ্জের মত ছোট-বড় দ্বীপ জেগে উঠেছে এবং নদী ভরাট হয়ে চর জেগে উঠেছে। এভাবে আমাদের আবাদী জমি ও বাসস্থান বাড়ছে এতে কোন সন্দেহ নেই।

মহান আল্লাহ বলেন,

‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-শান্তির উপাদান ও বাহন’ (কাহাফ ১৮/৪৬)

আল্লামা আলুসী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ধন-সম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায়। আর সন্তান হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার মাধ্যম। [35]

জনৈক রুশ লেখক তার Biological Tragedy of Woman গ্রন্থে বলেছেন, নারী জন্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানববংশ রক্ষা করা। [36] যৌন প্রেরণার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য মানববংশ বৃদ্ধির সঙ্গে দেহের প্রতিটি অঙ্গ স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে তৎপর। নারী দেহের বৃহত্তম অংশ গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মানোর উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট। [37] মা হাওয়াসহ পৃথিবীর সমস্ত নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য মানব বংশ রক্ষা ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে পারিবারিক কাঠামোতে সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালন।
আযল-এর বিধান :

প্রাচীনকালে আরব সমাজে ‘আযল’ করার যে প্রচলন ছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কোন আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে হাদীছে স্পষ্ট আলোচনা আছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল-

১. জাবির (রাঃ) বলেন,

كُنَّا نَعْزِلُ وَالْقُرْآنُ يَنْزِلُ

‘আমরা রাসূলের জীবদ্দশায় ‘আযল’ করতাম অথচ তখনও কুরআন নাযিল হচ্ছিল। [38]

অর্থাৎ পবিত্র কুরআনে ‘আযল’ সম্পর্কে কোন নিষেধবাণী আসেনি। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তা নিষেধ করেননি।

وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَزْوَةِ بَنِي الْمُصْطَلِقِ فَأَصَبْنَا سَبْيًا مِنْ سَبْيِ الْعَرَب فاشتهينا النِّسَاء واشتدت عَلَيْنَا الْعُزْبَةُ وَأَحْبَبْنَا الْعَزْلَ فَأَرَدْنَا أَنْ نَعْزِلَ وَقُلْنَا: نَعْزِلُ وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ أَظْهُرِنَا قَبْلَ أَنْ نَسْأَلَهُ؟ فَسَأَلْنَاهُ عَن ذَلِك فَقَالَ: مَا عَلَيْكُمْ أَلاَّ تَفْعَلُوْا مَا مِنْ نَسَمَةٍ كَائِنَةٍ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ إِلاَّ وَهِيَ كَائِنَةٌ-

২. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,

আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে বনী মুস্তালিকের যুদ্ধে বের হয়ে গেলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক আরবকে (দাসী) বন্দী করে নিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রমণীদের প্রতি আকর্ষণ জাগে। যৌন ক্ষুধাও তীব্র হয়ে উঠে এবং এ অবস্থায় ‘আযল করাকেই আমরা ভাল মনে করলাম। তখন এ সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জবাবে বললেন, তোমরা যদি তা কর তাতে তোমাদের ক্ষতি কি? কেননা আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি করবেন, তা তিনি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন এবং তা অবশ্যই সৃষ্টি করবেন। [39]

৩. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

তুমি কি সৃষ্টি কর? তুমি কি রিযিক দাও? তাকে তার আসল স্থানেই রাখ, সঠিকভাবে তাকে থাকতে দাও। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়ছালা রয়েছে। [40]

ইবনে সীরীন-এর মতে, لاعليكم ان لاتفعلوا এ বাক্যে ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ না থাকলেও এ যে নিষেধের একেবারে কাছাকাছি এতে কোন সন্দেহ নেই। [41]

হাসান বছরী বলেন, আল্লাহর শপথ, রাসূলের একথায় ‘আযল’ সম্পর্কে স্পষ্ট ভৎর্সনা ও হুমকি রয়েছে। [42]

ইমাম কুরতুবী বলেছেন, ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত কথা থেকে নিষেধই বুঝেছিলেন। ফলে এর অর্থ দাঁড়ায় রাসূল (ছাঃ) যেন বলেছেন, لاتعزلوا وعليكم ان لاتفعلوا তোমরা ‘আযল’ কর না, তা না করাই তোমাদের কর্তব্য। [43]

রাগিব ইসফাহানীর মতে, ‘আযল’ করে শুক্র বিনষ্ট করা এবং তাকে তার আসল স্থানে নিক্ষেপ না করা সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধ। [44]

মুয়াত্তা গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন যে, ইবনে ওমর (রাঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম যাঁরা ‘আযল’ পসন্দ করতেন না। [45]

عزل অর্থ হ’ল, পুরুষাঙ্গ স্ত্রী অঙ্গের ভেতর থেকে বের করে নেয়া যেন শুক্র স্ত্রী অঙ্গের ভেতরে স্খলিত হওয়ার পরিবর্তে বাইরে স্খলিত হয়।[46]

আইয়ামে জাহেলিয়াতে যেসব কারণে সন্তান হত্যা করা হ’ত, বর্তমান যামানায় জন্মনিয়ন্ত্রণও ঠিক একই কারণে গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সোনালী যুগের ‘আযল’-এর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে যুগে তিনটি কারণে মুসলমানদের মধ্যে ‘আযল’-এর প্রচলন ছিল।

(এক) দাসীর গর্ভে নিজের কোন সন্তান জন্মানো তাঁরা পসন্দ করতেন না, সামাজিক হীনতার কারণে।

(দুই) দাসীর গর্ভে কারো সন্তান জন্মালে উক্ত সন্তানের মাকে হস্তান্তর করা যাবে না, অথচ স্থায়ীভাবে দাসীকে নিজের কাছে রেখে দিতেও তারা প্রস্ত্তত ছিল না।

(তিন) দুগ্ধপায়ী শিশুর মা পুনরায় গর্ভ ধারণ করার ফলে প্রথম শিশুর স্বাস্থ্যহানীর আশংকা অথবা পুনরায় সন্তান গর্ভে ধারণ করলে মায়ের স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের আশংকা, কিংবা সন্তান প্রসবের কষ্ট সহ্য করার অনুপযুক্ত তা চিকিৎসকের পরামর্শে যথাযোগ্য বিবেচনায় এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

উপরোক্ত তিনটি কারণের মধ্যে প্রথম দু’টি কারণ আধুনিক যুগে বিলুপ্ত হয়েছে। শেষের তিন নম্বর কারণ ব্যতিরেকে সম্পদ সাশ্রয়ের জন্য ও নিজের আমোদ-প্রমোদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করা বৈধ নয়।

পরিশেষে বলব, জন্মনিয়ন্ত্রণ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সমস্যার প্রকৃত সমাধান নয়। বরং জনসংখ্যাকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর ও উৎপাদন বাড়ানো, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপকরণাদির উন্নয়ণের মধ্যেই রয়েছে এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থ হচ্ছে না বুঝে পরাজয় বরণ করা। একটি কাপড় কারো শরীরে ঠিকমত ফিট না হ’লে কাপড়টি বড় করার পরিবর্তে মানুষটির শরীর কেটে ছেঁটে ছোট করার মতই জন্মনিরোধ ব্যবস্থা অন্যায় ও অস্বাভাবিক। কেননা বিজ্ঞানের যুগে আমরা মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী তার শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!!

-----------------------------------------------------------------------------------
[1] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৯২), পৃঃ ১৩-১৫।
[2] . ডা. এস.এন. পান্ডে, গাইনিকলজি শিক্ষা, (কলিকাতা : আদিত্য প্রকাশনী, ১৯৭৭), পৃঃ ১২৪।
[3] . ঐ, পৃঃ ১২৫।
[4] . ঐ, পৃঃ ১৪।
[5] . Sehwarz Oswald, The Psycology of Sex (London : 1951), P. 50.
[6] . Cheser Is Chastity Outmoded, (Londen : 1960), P. 75.
[7] . নারী ৯৭ পৃঃ; হাফেয মাসঊদ আহমদ; আত-তাহরীক (বিশ্বে বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজে নারী : একটি সমীক্ষা-) (৬ষ্ঠ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা জানুয়ারী ২০০৩), পৃঃ ৪
[8] . George Lindsey, Revolt of Modern Youth P-82-83.
[9] . দৈনিক ইনকিলাব, ৬ই জুন ১৯৯৮ ইং।
[10] . মাসিক পৃথিবী (প্রশ্চাত্যে যৌন বিকৃতি, জুলাই ২০০১ইং, পৃঃ ৫২-৫৩।
[11] . জহুরী খবরের খবর, ১ খন্ড, ১১৬ পৃঃ।
[12] . মরিয়ম জামিলা, ইসলাম ও আধুনিকতা, ৯৯ পৃঃ।
[13] . খবরের খবর, ১ম খন্ড, ১১৬ পৃঃ।
[14] . সায়্যেদ কুতুব, ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, ৯৮ পৃঃ।
[15] . দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ এপ্রিল ২০১১, পৃঃ ৫।
[16] . নারী, পৃঃ ৮৫; আত-তাহরীক, জানুয়ারী ২০০৩, পৃঃ ৪।
[17] . ইসলাম ও আধুনিকত, পৃঃ ২৩।
[18] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬২।
[19] . Her self, Dr. Lowry, P-204.
[20] . কারেন্ট নিউজ (ডিসেম্বর সংখ্যা ২০০১), পৃঃ ১৯।
[21] . The New Straits Jimes, (Kualalampur, Malaysia, 23 june 1988), P-9.
[22] . প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১০, পৃঃ ৪।
[23] . গাইনিকলজি শিক্ষা, পৃঃ ১২৩।
[24] . মাওলানা আব্দুর রহিম, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২।
[25] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১২৮।
[26] . Report of the Royal Commission on population (1949), P-34.
[27] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১১২।
[28] . Family Planning Sterility and Population Growth (Newyork : 1959), P-5.
[29] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৮-৬৯।
[30] . ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম, পৃঃ ৯৮-১০১।
[31] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৬৯।
[32] . David M Levy, Maternal Over Protiction- (Newyork : 1943), P-35.
[33] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৭৩।
[34] . British Medical Journal, (London : 8 July, 1961), P-120.
[35] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৪০।
[36] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ৫৮।
[37] . The Psychology of Sex, P-17.
[38] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৪।
[39] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩১৮৬।
[40] . সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৭৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪০৩৮।
[41] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩৩।
[42] . ঐ।
[43] . ঐ।
[44] . ঐ, পৃঃ ৩৩৭।
[45] . ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ, পৃঃ ১০১-১০২।
[46] . পরিবার ও পারিবারিক জীবন, পৃঃ ৩৩২।

খুব উপকারী কিছু হাদীস

১. اتَّقِ اللَّه حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعْ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا وخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ
“আল্লাহকে ভয় কর যেখানেই থাকনা কেন। অন্যায় কাজ হয়ে গেলে পরক্ষণেই ভাল কাজ কর। তবে ভাল কাজ অন্যায়কে মুছে দিবে আর মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার কর।“ (তিরমিযী-সহীহ)
২. ((إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ))
“সব কাজই নিয়তের উপর নির্ভরশীল।“(সহীহ বুখারী)
৩. ((الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ))
“প্রকৃত মুসলিম সে ব্যক্তি যার মুখের ভাষা এবং হাত থেকে অন্য মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে।“ (সহীহ বুখারী)
৪. (( مَنْ غَشّنا فَلَيْسَ مِنِّا ))
যে আমাদের সাথে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (মুসলিম)
৫. ((مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلَا يُؤْذِ جَارَهُ))
“যে আল্লাহ এবং আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।“ (বুখারী)
খুব উপকারী কিছু হাদীস

৬ (( مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ ))
“যে আল্লাহ এবং আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।“ (বুখারী)
৭.مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ
“যে আল্লাহ এবং আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে সে যেন ভাল কথা বলে নতুবা চুপ থাকে।“ (বুখারী)
৮.(( مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ))
“একজন মানুষের একটি সুন্দর ইসলামী বৈশিষ্ট্য হল সে অযথা কাজ পরিত্যাগ করে।“ (মুওয়াত্তা মালিক)
৯. مَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ
“যে তার কোন ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন।“ (বুখারী)
১০. ((مَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ))
“যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের একটি কষ্ট দূর করবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাকে অনেক বিপদের মধ্য থেকে একটি বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।“ (বুখারী)
খুব উপকারী কিছু হাদীস

১১. ((مَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ))
“যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন।“ (বুখারী)
১২. ((عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَالْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ))
“সব সময় সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাক। কারণ সত্য কথা ভাল কাজের পথ দেখায়। আর ভাল কাজ জান্নাতের পথ দেখায়।“ (মুসলিম).
১৩. إِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ وَالْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ
“মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কারণ মিথ্যা অন্যায় কাজের পথ দেখায় আর অন্যায় কাজ জাহান্নামের পথ দেখায়।“ (মুসলিম)
১৪. الدَّالُّ عَلَى الْخَيْرِ كَفَاعِلِهِ
“যে ব্যক্তি ভাল কাজের রাস্তা দেখায় সে ঐ ব্যক্তির মতই সাওয়াব পায় যে উক্ত ভাল কাজ সম্পাদন করে।” (তিরমিযী-সহীহ)
১৫. اتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهَا لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ
“মজলুমের বদ দুয়াকে ভয় কর। কারণ, তার বদ দুয়া আর আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই।“ (বুখারী)

Wednesday, 5 December 2012

প্রোটিনের গঠনে আল্লাহর নিদর্শন

প্রোটিনের গঠনে আল্লাহর নিদর্শন


দুটো এমাইনো এসিড একটি দ্রবণে একত্রিত হলে পেপটাইড বন্ড তৈরী করে না বরং আয়োনিক বন্ধন তৈরী করতে চেষ্টা করে। কারন কোন দ্রবণে এমাইনো এসিডের কার্বক্সিল গ্রুপ হাইড্রোজেন আয়ন ছেড়ে দেয় এবং এমাইনো গ্রুপ সেটা গ্রহন করে। ফলে তৈরী হয় জুইটার আয়ন। এছাড়াও একটি রেসেমিক দ্রবণে অ্যামাইনো এসিডের ডান হাতি ও বাহাতি দুটো এনানসিওমার-ই সম পরিমাণে থাকবে । অর্থাৎ উভয়টির ৫০ শতাংশ। তত্ত্বমতে, প্রকৃতিতে প্রায় ২০০ অ্যামাইনো এসিড পাওয়ার কথা। এমনকি জীবদেহেও এমন অ্যামাইনো এসিড আছে যেটা প্রোটিন গঠনে ব্যাবহৃত হয় না।


অথচ জীবদেহের প্রোটিন তৈরীতে ব্যবহৃত এমাইনো এসিডের সংখ্যা ২০, এমাইনো এসিডগুলোর মধ্যে বন্ধন গঠিত হয় পেপটাইড বন্ড দিয়ে। তাও আবার আলফা কাবক্সিলিক গ্রুপের সাথে আলফা এমাইনো গ্রুপের। অথচ এসপারটিক এসিড ও গ্লুটামিক এসিডে যে সাইড চেইনেও কার্বক্সিলিক এসিড আছে। আবার লাইসিন, হিসটিডিনের সাইড চেইনে আছে এমাইনো ও ইমিনো গ্রুপ। পোলার সাইড চেইন যুক্ত এমাইনো এসিড হাইড্রোফিলিক ও ননপোলার সাইডেচেইনযুক্ত এমাইনো এসিড হাইড্রোফোবিক। ফলে একটি প্রোটিনে ননপোলার সাইডচেইনগুলো জড়াজড়ি করে মাঝামাঝি একত্রিত হতে চেষ্টা করে। আর পোলার সাইড চেইনযু্‌ক্ত এমাইনো এসিড গুলোকে বাইরের দিকে বিকর্ষণ করতে চায়।

(লুসিফেরিন প্রোটিন)

প্রোটিনে ব্যাবহৃত হয় কেবল বা-হাতি এমাইনো এসিড। আবার দুটো এমাইনো এসিডের মধ্যে বন্ধন তৈরী হলে এরা তাদের আলফা কার্বনের এক্সিসে রোটেট করতে পারে। কিন্তু প্রোটিনের ফাংশনাল হওয়ার জন্য দরকার হাইলি স্পেসিফিক ত্রিমাত্রিক গঠন। এ কারনে প্রোটিন গঠন হওয়ার জন্য এমাইনো এসিড চেইন হতে হবে খুবই স্পেসিফিক। তাদের মেইনটেইন করতে হবে, এনফিনসেন’স ডগমা অর্থাৎ হতে হবে স্ট্যাবল, ইউনিক ও কাইনেটিকেলি এক্সেসেবল। ফলে জন্ম নেয় লেভিনথাল প্যারাডক্স এর। কেননা এমনকি ১০০ এমাইনো এসিডের একটি প্রোটিনে যে সংখ্যক সম্ভাব্য কনফরমেশন হতে পারে, তা এক্সপ্লোর করতে গেলে পৃথিবীর বয়স ১০^২৬ সেকেন্ড কে ছাড়িয়ে যাবে। লক্ষ্য করুন, কোষের শুধুমাত্র ডি এন এ পলিমারেজ এনজাইমেই আছে ৯০০ থেকে ১০০০ এমাইনো এসিড।

অথচ কিছু বানরের বংশধর এসে বলা শুরু করেছে শত শত প্রোটিন, আর এন এ, রাইবোজম, ডি এন এ এবং ডি এন এ তে ইনস্টলড প্রোগ্রাম সহ একটি কোষ নাকি পৃথিবীর আদি সময়ে একা একা এমনি এমনি বাই চান্স তৈরী হয়ে গেছে?!? আর এই ধরণের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বৈচিত্রময় কোষের সমন্বয়ে গঠিত লক্ষ লক্ষ বিচিত্র প্রজাতি না কি র‍্যানডম মিউটেশনের মধ্যে দিয়ে আবির্ভূত হয়েছে!!!!!????!!!! আরে গাধা, তোমরা যাও তোমাদের পূর্ব পুরুষ শিম্পাঞ্জির(Pan troglodytes) সাথে আফ্রিকার বনে গিয়ে বসবাস কর। সভ্য মানুষের জগতে এসে ভাব ফলানোর প্রয়োজন নেই।

প্রোটিনের গঠন জানার পরও যদি কেউ পরম করুণাময়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে ব্যার্থ হয় তার সন্মন্ধে একটি ধারণাই মনে জন্মাবে, আর তা হল সে একজন সাটানিস্ট, দাজ্জালের চর, পৃথিবীর মানুষকে স্রষ্টার স্মরণ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যই তার সকল প্রচেষ্টা।

-Abdullah Saeed Khan

মধু ও কালোজিরা বিষয়ক

মধু ও কালোজিরা বিষয়ক

মধু একটি খুব উপকারী খাদ্য, পথ্য ও ঔষধ।জন্মের পর নানা দাদীরা মখে মধু দেয় নাই এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন । প্রাচীনকাল থেকে মানুষ প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে,মিষ্টি হিসেবে, চিকিৎসা ও সৌন্দর্যচর্চাসহ নানাভাবে মধুর ব্যবহার করে আসছে। শরীরের সুস্থতায় মধুর উপকারিতা অনেক।

আল কোরআনে আছে- আপনার পালনকর্তা মৌমাছিকে আদেশ দিলেন: পর্বতে, গাছে ও উঁচু চালে বাড়ি তৈরী কর,এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে খাও এবং আপন পালনকর্তার উন্মুক্ত পথে চলো। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (সূরা নাহলের ৬৮ ও ৬৯ নম্বর আয়াত)



এই আয়াত এটা স্পষ্ট যে মধু আমাদের জন্য কতখানি উপকারি।

মধু কি
মধু হচ্ছে একটি তরল আঠালো মিষ্টি জাতীয় পদার্থ, যা মৌমাছিরা ফুল থেকে নেকটার বা পুষ্পরস হিসেবে সংগ্রহ করে মৌচাকে জমা রাখে। পরবর্তীতে জমাকৃত পুষ্পরস প্রাকৃতিক নিয়মেই মৌমাছি বিশেষ প্রক্রিয়ায় পূর্ণাঙ্গ মধুতে রূপান্তর এবং কোষবদ্ধ অবস্থায় মৌচাকে সংরক্ষণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে মধু হচ্ছে এমন একটি অগাজানোশীল মিষ্টি জাতীয় পদার্থ যা মৌমাছিরা ফুলের নেকটার অথবা জীবন্ত গাছপালার নির্গত রস থেকে সংগ্রহ করে মধুতে রূপান্তর করে এবং সুনির্দিষ্ট কিছু উপাদান যোগ করে মৌচাকে সংরক্ষণ করে।

মধুর ভৌত বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের জাতীয় মধু বোর্ডের সংজ্ঞা অনুযায়ী "মধু হল একটি বিশুদ্ধ পদার্থ যাতে পানি বা অন্য কোন মিষ্টকারক পদার্থ মিশ্রিত করা হয় নাই।"মধু চিনিরচাইতে অনেক গুণ মিষ্টি। তরল মধু নষ্ট হয় না, কারণ এতে চিনির উচ্চ ঘনত্বের কারণে প্লাজমোলাইসিস প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। প্রাকৃতিক বায়ুবাহিত ইস্ট মধুতে সক্রিয় হতে পারে না, কারণ মধুতে পানির পরিমাণ খুব অল্প। প্রাকৃতিক, অপ্রক্রিয়াজাত মধুতে মাত্র ১৪% হতে ১৮% আর্দ্রর্তা থাকে। আর্দ্রর্তার মাত্রা ১৮% এর নিচে যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ মধুতে কোন জীবাণু বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। পাস্তুরাইয্‌ড মধুতে মধুর প্রাকৃতিক ঔষধি গুণাবলী হ্রাস পায়।

মধুতে যা বিদ্যমানঃ
মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। ফুলের পরাগের মধুতে থাকে ২৫-৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ। ৩৪-৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ০.৫-৩.০ শতাংশ সুক্রোজ এবং ৫-১২ শতাংশ মন্টোজ। আরো থাকে ২২ শতাংশ অ্যামাইনো এসিড, ২৮ শতাংশ খনিজ লবণ এবং ১১ ভাগ এনকাইম। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই। ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি।

আছে যত ধরনের মধুঃ
বিভিন্ন ফুল থেকে মধু হয় যেমন-সরিষা ফুল, লিচু, সুন্দর বন, কালজিরা থেকে আহরিত মধু। এ ছাড়া রয়েছে ধুনিয়া ফুল, গুজি তিল ও তৃষি থেকেও উৎপাদিত হয় মধু।প্রায় সব গুলুর গুনাগুন একই।

সবচেয়ে সেরা মধু
নিউজিল্যাণ্ডের মানুকা হানি বাজারে প্রাপ্য সকল মধুর চেযে বেশী চেযে ঔষধিগুণ সম্পন্ন গণ্য করা হয়। মানুকা নামীয় একপ্রকার ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদের ফুল থেকে উৎপন্ন মধু "মানুকা হানি" নামে পরিচিত।

মধুর ব্যাবহার
আধুনিক চিকিত্সাবিদ্যার জনক নামে পরিচিত হিপ্পোক্রেটস শরীরের প্রদাহ ও সিফিলিস রোগের চিকিত্সায় মধু ব্যবহার করতেন বলে কথিত আছে। ২ হাজার বছর আগেও যখন চিকিত্সা বিজ্ঞান আজকের মতো এতটা উন্নত ছিল না, তখনও মানুষ জানত মধুর কী গুণ! গ্রিক অ্যাথলেটরা অলিম্পিকে অংশগ্রহণের আগে প্রচুর পরিমাণ মধু সেবন করত শক্তি বাড়ানোর জন্য। তাদের ধারণা ছিল, মধু খেলে তাদের পারফরমেন্সের উন্নতি হবে।কারণ মধুতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ যা যকৃতে গ্রাইকোজেনের রিজার্ভ গড়ে তোলে।

খাটি মধুর বৈশিষ্ট্য
 খাটি মধুতে কখনো কটু গন্ধ থাকে না।
 মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো বিষাক্ত উপাদান প্রাকৃতিক গাছে থাকলেও তার প্রভাব মধুতে থাকে না।
 মধু সংরক্ষণে কোনো পৃজারভেটিভ ব্যবহৃত হয় না। কারণ মধু নিজেই পৃজারভেটিভ গুণাগুণ সম্পন্ন পুষ্টিতে ভরপুর খাদ্য।
 মধু উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত, নিষ্কাশন, সংরক্ষণ ও বোতলজাতকরণের সময় অন্য কোনো পদার্থের সংমিশ্রণ প্রয়োজন হয় না।
 খাটি মধু পানির গ্লাসে ড্রপ আকারে ছাড়লে তা সরাসরি ড্রপ অবস্থায়ই গ্লাসের নিচে চলে যায়।

খাটি মধুতে যে মান থাকা আবশ্যক
১. পানি শতকরা ২১ ভাগের বেশি নয়।
২. সুক্রোজ শতকরা ৫ ভাগের বেশি নয়।
৩. অ্যাশ শতকরা ১ ভাগের বেশি নয়।
৪. রিডিউসিং সুগার শতকরা ৬৫ ভাগের কম নয়।

খাঁটি মধু চেনার কিছু উপায়
বর্তমানে আমরা বাজার থেকে যে মধু কিনে আনি তা যে কতটুকু খাঁটি তা বলা মুশকিল । মধুর মধ্যে সাধারণত ভেজাল হিসেবে পানি, চিনি ও আরও অনেক কিছু মেশানো হয় । চলুন আমরা জেনে খাঁটি মধু চেনার কিছু উপায় -

১। ফ্রিজিং পরীক্ষা : মধুকে ফ্র্রিজের মধ্যে রেখে দিন । খাঁটি মধু জমবে না । ভেজাল মধু পুরাপুরি না জমলেও জমাট তলানী পড়বে।

২। পিঁপড়া পরীক্ষা : এক টুকরা কাগজের মধ্যে কয়েক ফোঁটা মধু নিন । তারপর যেখানে পিঁপড়া আছে সেখানে রেখে দিন । পিঁপড়া যদি মধুর ধারে কাছে না ঘেসে তবে তা খাঁটি মধু । আর পিঁপড়া যদি তা পছন্দ করে তবে মধুতে ভেজাল আছে।

৩। চক্ষু পরীক্ষা : খুব অল্প পরিমাণ মধু চোখের ভেতরে দিন । যদি মধু খাঁটি হয় তবে প্রথমে চোখ জ্বালাপোড়া করবে ও চোখ থেকে পানি বের হবে এবং খানিক পরে চোখে ঠান্ডা অনুভূতি হবে । (এই পরীক্ষায় অনুৎসাহিত করছি)

৪। দ্রাব্যতা পরীক্ষা : এক গ্লাস পানি নিয়ে এর মধ্যে এক টেবিল চামচ পরিমাণ মধু নিন । খুব ধীরে ধীরে গ্লাসটি শেক করুন । যদি মধু পানিতে পুরাপুরি দ্রবীভূত হয়ে যায় তবে তা ভেজাল মধু । আর মধু যদি পানিতে ছোট ছোট পিন্ডের আকারে থাকে তবে তা খাঁটি মধু ।
৫। মেথিলেটেড স্পিরিট পরীক্ষা : সমান অনুপাতে মধু এবং মেথিলেটেড স্পিরিট মিশ্রিত করে নাড়াতে থাকুন। খাঁটি মধু দ্রবীভুত না হয়ে তলনীতে জমা হবে । আর ভেজাল মধু দ্রবীভূত হয়ে মেথিলেটেড স্পিরিটকে মিল্কি করবে ।

৬। শিখা পরীক্ষা : একটি কটন উয়িক নিয়ে উহার এক প্রান্তকে মধুর মধ্যে ডুবিয়ে নেই । তারপর উঠিয়ে হালকা শেক করে নিই । একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে বা লাইটার জ্বলিয়ে তা আগুনের শিখায় ধরি । যদি তা জ্বলতে থাকে তবে মধু খাঁটি আর যদি না জ্বলে তবে মধুতে পানি মেশানো আছে । যদি মধুতে অল্প পরিমাণ পানি মেশানো থাকে তবে কটন উয়িক জ্বলতে থাকবে কিন্তু ক্র্যাকলিং সাউন্ড শোনা যাবে ।

৭। শোষণ পরীক্ষা : কয়েক ফোঁটা মধু একটি ব্লটিং পেপারে নিন ও পর্যবেক্ষণ করুন । খাঁটি মধু ব্লটিং পেপার কর্তৃক শোষিত হবে না । ভেজাল মধু ব্লটিং পেপারকে আর্দ্র করবে ।

৮। কলংক পরীক্ষা : একটুকরা সাদা কাপড়ের উপর সামান্য পরিমাণ মধু নিন এবং এবং কিছুক্ষন পর কাপড়টি ধৌত করুন । ধোয়ার পর কাপড়টিতে যদি কোন দাগ থাকে তবে মধুতে ভেজাল আছে । আর যদি কোন দাগ না থাকে তবে মধু খাঁটি ।

৯। হানি কম্ব পরীক্ষা : একটি কাঁচের বা সাদা রংয়ের বোলের মধ্যখানে দেড় থেকে দুই চা চামচ (প্লস্টিকের তৈরি) মধু নেই । তারপর বোলের চারদিক দিয়ে ধীরে ধীরে ঠান্ডা পানি ঢালতে থাকি । যখন পানি মধুকে ঢেকে ফেলবে তখন পানি ঢালা বন্ধ করি । তারপর বোলটিকে তুলে ধরে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে দুই মিনিট ধরে ঘুরাতে থাকি । খাঁটি মধু এই মুভমেন্টের পরেও পানিতে দ্রবীভূত হবে না এবং হেক্সাগোনাল আকৃতি ধারণ করবে যা দেখতে প্রায় হানি কম্ব এর মত।নিচে হানি কম্ব এর একটি চিত্র দেওয়া হল।


১০। স্বচক্ষে দেখা পদ্ধতি : এই পরীক্ষগুলো না করেও খাঁটি মধু সম্পর্কে নিশ্চত হতে পারবেন যদি আপনি নিজে উপস্থিত থেকে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে আনতে পারেন ।

মধুর উপকারিতা
মধুর উপকারিতার কথা লিখে শেষ করা যাবে না।মধুর নানাবিধ উপকারিতা নিম্নে প্রদত্ত হলঃ

শক্তি প্রদায়ী
মধু ভালো শক্তি প্রদায়ী খাদ্য। মধু তাপ ও শক্তির ভালো উৎস। মধু দেহে তাপ ও শক্তি জুগিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে।

হজমে সহায়তা
এতে যে শর্করা থাকে তা সহজেই হজম হয়। কারণ এতে যে ডেক্সট্রিন থাকে তা সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়া করে।পেটরোগা মানুষদের জন্য মধু বিশেষ উপকারি।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।১ চা চামচ খাঁটি মধু ভোরবেলা পান করলে কোষ্ঠবদ্ধতা এবং অম্লত্ব দূর হয়।

রক্তশূন্যতায়
মধু রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠনে সহায়তা করে বলে এটি রক্তশূন্যতায় বেশ ফলদায়ক।কারণ এতে থাকে খুব বেশি পরিমাণে কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ।

ফুসফুসের যাবতীয় রোগ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে
বলা হয়, ফুসফুসের যাবতীয় রোগে মধু উপকারী। যদি একজন অ্যাজমা (শ্বাসকষ্ট) রোগীর নাকের কাছে ধরে শ্বাস টেনে নেয়া হয় তাহলে সে স্বাভাবিক এবং গভীরভাবে শ্বাস টেনে নিতে পারবেন। কেউ কেউ মনে করেন, এক বছরের পুরনো মধু শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য বেশ ভালো।

অনিদ্রায়
মধু অনিদ্রার ভালো ওষুধ। রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস পানির সঙ্গে দুই চা চামচ মধু মিশিয়ে খেলে এটি গভীর ঘুম ও সম্মোহনের কাজ করে।

যৌন দুর্বলতায়
পুরুষদের মধ্যে যাদের যৌন দুর্বলতা রয়েছে তারা যদি প্রতিদিন মধু ও ছোলা মিশিয়ে খান তাহলে বেশ উপকার পাবেন।

প্রশান্তিদায়ক পানীয়
হালকা গরম দুধের সঙ্গে মিশ্রিত মধু একটি প্রশান্তিদায়ক পানীয়।

মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য রক্ষায়
মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য রক্ষায় মধু ব্যবহৃত হয়। এটা দাঁতের ওপর ব্যবহার করলে দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। দাঁতে পাথর জমাট বাঁধা রোধ করে এবং দাঁত পড়ে যাওয়াকে বিলম্বিত করে।মধু রক্তনালিকে সম্প্রসারিত করে দাঁতের মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষা করে। যদি মুখের ঘায়ের জন্য গর্ত হয়। এটি সেই গর্ত ভরাট করতে সাহায্য করে এবং সেখানে পুঁজ জমতে দেয় না। মধু মিশ্রিত পানি দিয়ে গড়গড়া করলে মাড়ির প্রদাহ দূর হয়।

পাকস্থলীর সুস্থতায়
মধু পাকস্থলীর কাজকে জোরালো করে এবং হজমের গোলমাল দূর করে। এর ব্যবহার হাইড্রোক্রলিক এসিড ক্ষরণ কমিয়ে দেয় বলে অরুচি, বমিভাব, বুক জ্বালা এগুলো দূর করা সম্ভব হয়।

দেহে তাপ উৎপাদনে
শীতের ঠান্ডায় এটি দেহকে গরম রাখে। এক অথবা দুই চা চামচ মধু এক কাপ ফুটানো পানির সঙ্গে খেলে শরীর ঝরঝরে ও তাজা থাকে।

পানিশূন্যতায়
ডায়রিয়া হলে এক লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার মধু মিশিয়ে খেলে দেহে পানিশূন্যতা রোধ করা যায়।

দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে
চোখের জন্য ভালো।গাজরের রসের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে।

রূপচর্চায়
মেয়েদের রূপচর্চার ক্ষেত্রে মাস্ক হিসেবে মধুর ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। মুখের ত্বকের মসৃণতা বৃদ্ধির জন্যও মধু ব্যবহূত হয়।

ওজন কমাতে
মধুতে নেই কোনো চর্বি। মধু পেট পরিষ্কার করে,মধু ফ্যাট কমায়, ফলে ওজন কমে।

হজমে সহায়তা
মধু প্রাকৃতিকভাবেই মিষ্টি। তাই মধু সহজে হজম হয় এবং হজমে সহায়তা করে।

গলার স্বর
গলার স্বর সুন্দর ও মধুর করে।

তারুণ্য বজায় রাখতে
তারুণ্য বজায় রাখতে মধুর ভূমিকা অপরিহার্য। মধু এন্টি অক্সিডেন্ট, যা ত্বকের রং ও ত্বক সুন্দর করে। ত্বকের ভাঁজ পড়া ও বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে।শরীরের সামগ্রিক শক্তি বাড়ায় ও তারুণ্য বাড়ায়।

হাড় ও দাঁত গঠনে
মধুর গুরুত্বপূর্ণউপকরণ ক্যালসিয়াম। ক্যালসিয়াম দাঁত, হাড়, চুলের গোড়া শক্ত রাখে, নখের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে, ভঙ্গুরতা রোধ করে।

রক্তশূন্যতা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
মধুতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, যা রক্তশূন্যতা,কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।

আমাশয় এবং পেটের পীড়া নিরাময়ে
পুরনো আমাশয় এবং পেটের পীড়া নিরাময়সহ নানাবিধ জটিল রোগের উপকার করে থাকে।

হাঁপানি রোধে
আধা গ্রাম গুঁড়ো করা গোলমরিচের সাথে সমপরিমাণ মধু এবং আদা মেশান। দিনে অন্তত তিন বার এই মিশ্রণ খান। এটা হাঁপানি রোধে সহায়তা করে।

উচ্চ রক্তচাপ কমায়
দু চামচ মধুর সাথে এক চামচ রসুনের রস মেশান। সকাল-সন্ধ্যা দুবার এই মিশ্রণ খান। প্রতিনিয়ত এটার ব্যবহার উচ্চ রক্তচাপ কমায় ।প্রতিদিন সকালে খাবার এক ঘণ্টা আগে খাওয়া উচিত ।

রক্ত পরিষ্কারক
এক গ্লাস গরম পানির সাথে এক বা দুই চামচ মধু ও এক চামচ লেবুর রস মেশান। পেট খালি করার আগে প্রতিদিন এই মিশ্রন খান। এটা রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। তাছাড়া রক্তনালীগুলোও পরিষ্কার করে।

রক্ত উৎপাদনে সহায়তা
রক্ত উৎপাদনকারী উপকরণ আয়রন রয়েছে মধুতে। আয়রন রক্তের উপাদানকে (আরবিসি, ডব্লিউবিসি, প্লাটিলেট) অধিক কার্যকর ও শক্তিশালী করে।

হৃদরোগে
এক চামচ মৌরি গুঁড়োর সাথে এক বা দুই চামচ মধুর মিশ্রণ হৃদরোগের টনিক হিসেবে কাজ করে। এটা হৃদপেশিকে সবল করে এবং এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়ায়
মধু শরীরের রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়ায় এবং শরীরের ভেতরে এবং বাইরে যে কোনো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতাও যোগান দেয়।মধুতে আছে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধকারী উপাদান, যা অনাকাঙ্ক্ষিত সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে।

২০০৭ সালে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায়, সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধে মধু অত্যন্ত কার্যকর।বিভিন্ন ভাইরাসের আক্রমণে বিভিন্ন রোগ প্রায়ই দেহকে দুর্বল করে দেয়। এসব ভাইরাস প্রতিরোধে মধু খুবই কার্যকর।

জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছেযে মধুতে রয়েছে উচ্চশক্তিসম্পন্ন অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল এজেন্ট। এই এজেন্ট শরীরের ক্ষতিকর রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে।

ব্যথা নিরাময়ে
আপনার শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা? প্রচুর বাতের ওষুধ খেয়েও কোনো ফল পাননি? মধু খান। যে অবাঞ্ছিত রসের কারণে শরীরে বাতব্যামোর জন্ম, সে রস অপসারিত করবে মধু। আপনার বাত সেরে যাবে।

গ্যাস্ট্রিক-আলসার থেকে মুক্তি
হজম সমস্যার সমাধানেও কাজ করে মধু।একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্যাস্ট্রিক-আলসার থেকে মুক্তি পেতে একজন ব্যক্তি দিনে তিনবেলা দুই চামচ করে মধু খেতে পারে।

মধু খেলে বুদ্ধি বাড়ে
মধু যে শুধু কায়িক শক্তি বাড়ায়, তা নয়। আপনি প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে এক চামচ মধু খাবেন, ঘুমানোর আগে এক চামচ মধু মস্তিষ্কের কাজ সঠিকভাবে চালাতে সাহায্য করে ফলে আপনার মস্তিষ্কের শক্তি তথা বুদ্ধির জোর বেড়ে যাবে। যে কোনো কাজেকর্মে আপনার মগজ আগের চেয়ে বেশি খেলবে। যাদের মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়, তাদের জন্য মধু এনে দেবে নতুন উদ্যম ও সৃষ্টিশীলতা। মনে রাখবেন, আপনি ঘুমিয়ে পড়লেও আপনার মস্তিষ্ক কিন্তু জেগে থাকে। সুতরাং তখনও তার শক্তি দরকার। আর এ শক্তির ভালোই যোগান দেয় মৌমাছির চাক ভেঙে পাওয়া এই প্রাকৃতিক মধু। আপনার লিভারে মধু থেকে পাওয়া ফলজ শর্করা বা ফ্রুকটোজ নামের পদার্থটিই মস্তিষ্কের জ্বালানি হিসেবেই কাজ করে থাকে।মানুষের লিভারে শক্তি সংরক্ষণ করে এবং রাতব্যাপি মস্তিষ্কে শক্তি সরবরাহ করে থাকে।

ঠান্ডা দূর করে মধু
মধু নিয়মিত খেলে অতিরিক্ত ঠান্ডা লাগার প্রবণতা দূর হবে। চা, কফি ও গরম দুধের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে হাঁচি, কাঁশি, জ্বর জ্বর ভাব, জ্বর, গলাব্যথায়,টনসিল, নাক দিয়ে পানি পড়া,জিহ্বার ঘা (ঠান্ডাজনিত) ভালো হয়।

সমপরিমাণ আদারস এবং মধুর মিশ্রণ কাশির সাহায্যে শ্লেষ্মা বের করে ফেলার একটি সহায়ক ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এটি ঠান্ডা, কাশি, কণ্ঠনালির ক্ষত, নাক দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি থেকে দ্রুত পরিত্রাণ দেয়।

পেনসিলভানিয়া স্টেট কলেজ অব মেডিসিনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এক চামচ মধু বিভিন্ন সর্দির ওষুধ থেকেও অনেক বেশি কার্যকর।মধুর এই ঠাণ্ডাজনিত রোগনিরোধী গুণের কথা বলা হয়েছে এই গবেষণায়,যা কবিরাজি মতে আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত।

শিশুদের বৃদ্ধি ও বিকাশে
শিশুদের ছয় মাস বয়সের পর থেকে অল্প করে (তিন-চার ফোঁটা) মধু নিয়মিত খাওয়ানো উচিত। এতে তাদের পুরো দেহের বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ ভালো হবে। তবে শিশুকে মধু নিয়মিত খাওয়াতে হবে ঠান্ডা ঋতুতে, গরমের সময় নয়।শিশুদের দুর্বলতা দূর করার জন্যমধুতে রয়েছে জিংক ও ফসফরাস।বড়দের তুলনায় বাড়ন্ত শিশুদের (বিশেষ করে যারা স্কুলে যায়) জন্য পরিমাণে মধু বেশি প্রয়োজন।

আয়ু বৃদ্ধি
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নিয়মিত মধু ও সুষম খাবারে অভ্যস্ত ব্যক্তিরা তুলনামূলকভাবে বেশি কর্মক্ষম ও নিরোগ হয়েবেঁচে থাকে।

ক্ষত সারাতে মধু
উপকারী।প্রাচীন কাল তেকে গ্রিস ও মিশরে ক্ষত সারাইয়ে মধু ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ২০০৭-এ সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষত ও জখমের উপশমে মধু ডাক্তারী ড্রেসিং-এর চেয়েও বেশী কার্যকর। অগ্নিদগ্ধ ত্বকের জন্যও মধু খুব উপকারী।

আজকাল ছোটখাটো কাটাছেঁড়া সারাতেও মধুর ব্যবহারের কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা।২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. শোন ব্লেয়ার বলেছেন, ক্ষতে ইনফেকশন সৃষ্টি হওয়া প্রতিরোধ করতেও ড্রেসিংয়ের সময় মধু মেশানো উচিত।

ধরুন, আপনার শরীরের কোন অংশ কেটে গেল হাতের কাছে এ্যান্টিবায়োটিক অয়েন্টমেন্ট নেই। এবার বিকল্প হিসাবে আপনার ঘরের মধুটি আপনার কাজে আসতে পারে। মধু ব্যাকটেরিয়ার আক্রামণকেও ঠেকায়। এভাবে মধু আপনার ক্ষতে ইনফেকশন হতে দেবে না এবং ক্ষতটি ও দ্রুত সারিয়ে তুলবে। মধুর এমন মধুরতম ব্যবহার আর কি হতে পারে?

কিন্তু কিভাবে ব্যবহার করবেন? এটা এবার জেনে নিন। প্রথমে ক্ষত স্থনটি ভাল করে ধুয়ে নিন। তারপর আলতো করে সেখানে পাস্তুরিত মধু লাগিয়ে নিন। এবার ব্যান্ডেজ দিয়ে জায়গাটা বেঁধে নিন। ব্যস, এভাবে দিনে তিনবার। ক্ষত সেরে যাবে।

তাছাড়া দেহের ক্ষত এবং ফোঁড়ার ওপর মধু এবং চিনি চমৎকার কাজ করে থাকে। এটি যে কোনো ব্যথাকে প্রশমিত করে এবং জীবাণুনাশকের কাজ করে।

মধু বনাম চিনি
একজন মানুষের জন্য দৈনিক যত ক্যালরি খাদ্য দরকার, তার ২২ ক্যালরি পাওয়া যায় এক চা চামচ মধুতে। একই পরিমাণ চিনিতে পাওয়া যাবে ১৫ ক্যালরি। তবু এক কেজি চিনির চেয়ে এক কেজি মধুর দাম অনেক বেশি। কারণ, চিনি যতটা সহজলভ্য মধু ততটা নয়। অবশ্য মধু চিনির চেয়ে দুষ্প্রাপ্য বলেই যে এর দাম বেশি, তাও নয়। আসলে চিনির চেয়ে মধুর দ্রব্যগুণটা মানব শরীরে অনেক বেশি সক্রিয়। তাই প্রাকৃতিকভাবে তৈরি মধুর কাছে কারখানায় তৈরি চিনি তেমন পাত্তা পায় না। খাদ্যবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মধুতে রয়েছে প্রচুর গ্লুকোজ আর ফলজ শর্করা। এটি দিয়ে লিভারে সঞ্চিত হয় প্রচুর পরিমাণে গ্লাইকোজেন। আর এতে শরীরে পাওয়া যায় অমিত শক্তি ও প্রাণচাঞ্চল্য।

মধুর দানাদার সমস্যা
অনেক মধু দানাদার আকার ধারণ করে। যদি কোনো মধুতে গ্লুকোজের পরিমাণ ফ্রুক্টোজের চেয়ে বেশি থাকে তখন সে মধু অতি দ্রুত দানাদার হয়। যেমন সরিষা ফুলের মধু। আবার মধুতে পর্যাপ্ত পোলেন, ধুলাবালি ও বুদবুদ থাকলে সে মধু সহজে দানাদার হয়। সাধারণত ১১ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মধু জমতে পারে। তবে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা মধু অতি দ্রুত জমতে সহায়ক। পানির পরিমাণ বেশি থাকলে মধুকে দানাদার হতে ত্বরান্বিত করবে। তবে দানাদার মধু খেতে কোনো সমস্যা নেই। দানাদার মধুকে পরোক্ষ তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তরল করা যায় বা কৃম মধুতে রূপান্তর করা যায়। দানাদার মধু ছয় মাসের মধ্যে ব্যবহার করা উত্তম।

সতর্কতা
মধু সব রোগের মহৌষধ হলেও একটি কথা থেকেই যায়, সেটি হলো ডায়াবেটিস রোগের ক্ষেত্রে মধু খুবই বিপজ্জনক। কারণ এটি রক্তে সরাসরি শোষিত হয় বলে সহজেই দেহের রক্ত শর্করাকে উচ্চস্তরে নিয়ে আসবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মধু গ্রহণ নিষেধ।

তাছাড়া মধু সবার শরীরে গরম তৈরি করে। যেকোনো বয়সের মানুষ অধিক পুষ্টির আশায় বেশিমধু খেলে ডায়রিয়া হয়ে যাবে।

শোভন এর ব্লগ থেকে কপি

কালোজিরা


প্রাচীনকাল থেকে কালোজিরা মানবদেহের নানা রোগের প্রতিষেধক এবং প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রায় ১৪শ’ বছর আগে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, ‘কালোজিরা রোগ নিরাময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তোমরা কালোজিরা ব্যবহার কর, নিশ্চয়ই প্রায় সব রোগের নিরাময় ক্ষমতা এর মধ্যে নিহিত রয়েছে।’ সে জন্য যুগ যুগ ধরে পয়গম্বরীয় ওষুধ হিসেবে সুনাম অর্জন করে আসছে।
সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম চিকিত্সা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্যানন অব মেডিসিন’-এ বলেছেন, ‘কালোজিরা দেহের প্রাণশক্তি বাড়ায় এবং ক্লান্তি দূর করে।’ কালোজিরাতে শতাধিক পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এর প্রধান উপাদানের মধ্যে প্রোটিন ২১ শতাংশ, শর্করা ৩৮ শতাংশ, স্নেহ ৩৫ শতাংশ। এছাড়াও রয়েছে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ। প্রতি গ্রামে যেসব পুষ্টি উপাদান রয়েছে তা নিম্নরূপ—প্রোটিন ২০৮ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন-বি ১.১৫ মাইক্রোগ্রাম, নিয়াসিন ৫৭ মাইক্রোগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১.৮৫ মাইক্রোগ্রাম, আয়রন ১০৫ মাইক্রোগ্রাম, ফসফরাস ৫.২৬ মিলিগ্রাম, কপার ১৮ মাইক্রোগ্রাম, জিঙ্ক ৬০ মাইক্রোগ্রাম, ফোলাসিন ৬১০ আইউ

কালোজিরার গুণের শেষ নেই
— প্রতিদিন সকালে এক চিমটি কালোজিরা এক গ্লাস পানির সঙ্গে খেলে ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
— হাঁপানি রোগীদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় কালোজিরায় উপকার পাওয়া যায়।
— নারী-পুরুষের যৌন অক্ষমতায় নিয়মিত কালোজিরা সেবনে যৌনশক্তি বৃদ্ধি পায়।
— কালোজিরায় রয়েছে ১৫টি অ্যামাইনো এসিড। আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজন ৯টি এসেনসিয়াল অ্যামাইনো এসিড যা দেহে তৈরি হয় না, অবশ্যই খাবারের মাধ্যমে এর অভাব পূরণ করতে হয়। আর কালোজিরায় রয়েছে আটটি এসেনসিয়াল অ্যামাইনো এসিড।
— সর্দি-কাশি সারাতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
— প্রসূতি মাতাদের দুগ্ধ বাড়াতে ও নারী দেহের মাসিক নিয়মিতকরণে এবং মাসিকের ব্যথা নিবারণে কালোজিরার ভূমিকা রয়েছে।
— নিয়মিত কালোজিরা সেবনে চুলের গোড়ায় পুষ্টি ঠিকমত পায়, ফলে চুলের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং চুল পড়া বন্ধ হয়। মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রক্ত সঞ্চালন ও বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয় এবং সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে।

Tuesday, 13 November 2012

৫দিনের জোড় কে সামনে রেখে ৬জিলার মেহনতের বয়ান

৫দিনের জোড় কে সামনে রেখে ৬জিলার মেহনতের বয়ান


Sunday, 11 November 2012

সবগুজারী মসজিদে বযান


মুফতি নজরুল ইসলাম সাহেবের ঢাকার বিভিন্ন সবগুজারী মসজিদে বয়ান



Sunday, 4 November 2012

অরুন কুমার চক্রবর্তী


একজন নও মুসলিমের আত্মকাহিনী

একজন নও মুসলিমের আত্মকাহিনী
আমার ইসলাম পূর্ব নাম; অরুন কুমার চক্রবর্তী, বর্তমান নাম: মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম, পিতার নাম: ডা. ফনিভূষণ চক্রবর্তী, গ্রাম: মাস্টার পাড়া (লাকসাম রোড), পোস্ট: কান্দির পাড়, থানা: কোতয়ালী, জেলা: কুমিল্লা, বাংলাদেশ।
যখন কেউ আমার ইসলাম গ্রহণের কথা শুনে, তখন তাদের অনেকেই আমার কাছে আমার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে জানতে চান। আমি তাদেরকে খুব সংক্ষেপে আমার ইসলাম গ্রহণের কারণ বলি। অনেক দিন ধরেই আমার ইসলাম গ্রহণের পূর্ণ কাহিনী লিখবো বলে ভাবতে ছিলাম। আমি ভীষণ অলস প্রকৃতির লোক, তাই লিখা হয়ে উঠছে না। আই পি সির সম্মানিত দাঈ মুহতারম মাওলানা মামুনুর রশীদ ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় এবং ভিন্ন আরো একটি কারণে লিখতে শুরু করলাম। কারণটি হলো; কোন অমুসলিম যদি আমার জীবনের আত্মকাহিনী পাঠ করে সঠিক পথের সন্ধান পায় কিংবা কোন মুসলমান সঠিকভাবে ইসলাম পালন করে, তাহলে আমার ইসলাম গ্রহণের স্বার্থকতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
  আমার জন্ম হয়েছে এক বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারে।‏ ব্রাহ্মণদের মধ্যেও উঁচু নিচু শ্রেণীভাগ আছে। আমার পিতার বংশ ছিল ব্রাহ্মণদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ। হিন্দু শাস্ত্রে যাকে কুলিন বংশ বলে। আমার পিতা ছিলেন খুবই ধার্মিক ও সৎ। আমি ৯ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে ছিলাম দশম। আমার যখন জন্ম হয় তখন আমার গলায় ব্রাহ্মণ মতে পৈতা ছিল- হিন্দুরা যেহেতু পুনজনমে বিশ্বাসী তাই তাদের ধারণা আমি আগের জনমেও ব্রাহ্মণ ছিলাম। দ্বিতীয় বার যদি কেউ ব্রাহ্মণ হিসেবে জন্ম নেয়, তবে সে পরোলোকে চলে গেলে তার স্বর্গবাস। তাছাড়া আমার আগমন কালে আমার পরিবারে অনেক মঙ্গলবার্তা বয়ে আনে। (আলহামদুলিল্লাহ বর্তমানে আমি একজন মুসলমান, আমি বিশ্বাস করি যদি আমার মৃত্যু ঈমানের সাথে হয় তাহলে অবশ্যই আমি জান্নাতে যাবো। আমি আল-হুদার সকল পাঠক-পাঠিকাদের নিকট দোয়া প্রার্থী, সকলে আমার জন্য দোয়া করবে। আল্লাহ যেন আমাকে ঈমানের সাথে মৃত্যু দান করেন। আমীন)
আশ্চর্যের বিষয় এমন এক পরিবারে জন্ম নিয়ে মুসলমান হয়ে মৃত্যুবরণ করবো তা এক অসম্ভব ব্যাপার ছিলো। কিন্তু রাব্বুল আলামীন যা চান তাই হয়, আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ যার মঙ্গল কামনা করেন, তাকেই তিনি দ্বীনের বোঝ দান করেন। (বুখারী…)
ছোট বেলা থেকেই আমি খুব ধার্মিক ছিলাম। হিন্দুদের পূজা-পালিতে আমি নিয়মিত অংশ নিতাম, এবং ব্রাহ্মণের কার্যাদি ভালোভাবেই পালন করতাম। এভাবে আমি চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত উত্তীর্ণ হই। তারপর থেকেই আমার মধ্যে বিভিন্ন নেশার আগ্রহ জন্ম নেয়া শুরু হলো। হিন্দু ধর্মে যেহেতু মদ-গাজা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো, তাই অবাধে তাতে আকৃষ্ট হয়ে গেলাম. ক্রমশ আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে যাচ্ছিলাম। পড়াশুনায় ভাল ছিলাম বলে পরীক্ষায় ভালোভাবেই পাস করতাম। সারা দিন ঘুড়ি উড়ানো, গুল্লি ইত্যাদি খেলায় মগ্ন থাকতাম। এভাবেই পার করছিলাম কৈশোরের দিনগুলো। যখন অষ্টম শ্রেণীতে উঠি তখন থেকেই বাহিরে থাকার অভ্যাসটা প্রবল হয়ে গেল। ঘরে ভালো লাগতো না। কোন হোটেলের সামনে দাঁড়াতাম, কেউ হয়ত একটা সিঙ্গারা দিলে বা একটা লুচি দিলে তা খেতাম। একবার ঘর থেকে চলে গিয়ে তিন দিন অন্য বাড়িতে ছিলাম। এই তিন দিন যে কোথায় ছিলাম, আজও তার হদিস খোঁজে বের করতে পারি নাই। এভাবে (SSC) পাস করার পর চলে যাই চট্টগ্রামে। সেখানে কলেজে ভর্তি হই। সেখানে গিয়ে পুরোপুরি নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। এভাবে একসময় জীবনের প্রতি কেমন যেন বিতৃষ্ণা এসে যায়। কোথাও ৫/৬ মাসের বেশি থাকতে পারতাম না। তার মধ্যে বিভিন্ন বন্ধুদের পাল্লায় পরে বিভিন্ন নেশা জাতীয় টেবলেট, ফেনসিডিল তার সাথে জুয়া খেলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। তবে আমার একটা অভ্যাস ছিলো যে কোন কিছুতেই আমাকে গ্রাস করতে পারতো না। কোন না কোন সময় বিরক্ত লাগতো, মনে হতো কেউ যেন আমাকে ব্যবহার করছে। যখন দেখছে অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে, তখনই আমাকে এটার প্রতি বিমুখ করে রাখতো। এভাবে আমার জীবন হ য ব র ল -এর মতো চলছিল। এই হ য ব র ল জীবনের মাঝেই আই এ. ও বি এ. পাস করি। তখন আমি ঢাকায় ছিলাম। 
ভারতের বাবরী মসজিদে নিয়ে বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঢাকায় ছোট খাট একটা দাঙ্গা হয়। আমি থাকতাম পুরান ঢাকার শাখারী বাজার ওয়াইজ ঘাট এলাকায়। যখন দাঙ্গা শুরু হয়, তখন আমি বাইরে ছিলাম, বাসায় ঢুকার মত পরিবেশ ছিল না। এভাবে তিন দিন শাখারী বাজারে রাস্তায় পার করে দিয়েছি। যখন এই দাঙ্গা ঠাণ্ডা হলো তখন ভাবলাম, মানবতার এমন অবক্ষয় কি করে হয়! মানুষ মানুষের প্রতি মুহূর্তের মধ্যে এমন ভয়ানক রূপ ধারণ করতে পারে, জীবনে এটাই মানুষের রূপ প্রথম দেখা। তাই বাংলাদেশ ছেড়ে কলিকাতা চলে চাই। সেখানে বাসা ভাড়া করে থাকতাম। একটি ভালো চাকরী ব্যবস্থাও হয়ে গেল। কিছু দিনের মধ্যে অনেক বন্ধু-বান্ধব জুটে গেল। সেখান বন্ধুরা বাংলাদেশী বন্ধু পেয়ে খুব খুশি। সেখানে প্রতি পাড়া মহল্লায় বাংলা মদের আসর বসতো, বন্ধুদের সাথে প্রতি দিন সন্ধ্যায় মদের আসরে গিয়ে মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পরলাম। সেখানে একটি মেয়ের প্রেমে পড়লাম। মেয়েটি আমার প্রতি এতই আকৃষ্ট হলো যে সব লোক লজ্জা ভয় উপেক্ষা করে প্রতি রাতে আমার সাথে থাকতো। এভাবে সেখানে প্রায় আড়াই বছর গত হয়ে যায়। তিন মাস পার হওয়ার পর এক দিন সন্ধ্যায় বন্ধুরা মদের আড্ডায় যাওয়ার জন্য নিতে আসলো। ঘর থেকে বের হয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর থমকে দাঁড়ালাম। আমার বিবেক আমাকে প্রশ্ন করছে: কে তুমি, কি তোমার পরিচয়, পৃথিবীতে কেন এসেছ, তোমার কি করা উচিত? কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কিছু সময় কাটলো। তারপর দেখলাম বন্ধুরা সবাই চলে গেছে, আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। এরপর থেকেই কিছু ভাল লাগতো না। কেমন যেন মনে শুধু অস্থিরতা বিরাজ করতো, হৃদয় শুধু আঞ্চান আঞ্চান করতো। এক মাস পর কলিকাতা থেকে নানা বাড়ি ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই নামক জেলায় চলে আসি। এখানে আসার পর মন আরো ব্যাকুল হয়ে গেল, কেন যে এমন হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। সকালে চলে যেতাম গভীর জঙ্গলে বিকালে ফিরতাম ঘরে। সারা দিন জঙ্গলে বসে শুধু কাঁদতাম। জ্জ মাস থাকার পর বাংলাদেশে চলে আসি। কিন্তু ব্যাকুলতা দূর হলো না, আমি ভেবে শেষ করতে পারছি না কেন যে এমন হচ্ছে। কি যেন খুঁজছি কিন্তু তার সন্ধান পাচ্ছি না। বাংলাদেশে আসার পর আমার পরিবার খুব বিরক্ত বোধ করছিল। কিছু দিন ঘুরাঘুরি করার পর কয়েকটি টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতে লাগলাম। এবং কুমিল্লা আইন কলেজে এল এল বিতে ভর্তি হলাম। প্রথম বর্ষে হিন্দু আইন ও মুসলিম আইন দুইটি বই ছিল। হিন্দু আইন পড়তে গিয়ে দেখলাম: হিন্দু আইনটা হলো; কোন কর্তা ব্যক্তি যদি বলতো: “এই রাস্তা দিয়ে কেউ চলাচল করতে পারবে না” তার এই উক্তি যদি সকলে ১০০ বছর মেনে চলে সেটা হিন্দু আইনে পরিণত হয়ে যেত। হিন্দু আইনটা পুরোপুরি মানুষের তৈরী। যার মধ্যে ধর্মের কোন প্রাধান্য ছিল না। পক্ষান্তরে মুসলিম আইন পড়তে গিয়ে আমি আভিভূত হয়ে গেলাম। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, সম্পত্তি বণ্টন বিচার ব্যবস্থা, ব্যবসা বাণিজ্য, সামাজিক বন্ধন সবটাতেই আল্লাহর হুকুম ও নির্দেশনা রয়েছে। এত সুন্দরভাবে মহান আল্লাহ ব্যাখ্যাসহকারে বিষয়গুলি উপস্থাপন করেছেন, যা কোন ইনসানের পক্ষে কস্মিনকালেও সম্ভব হবে না। যা পরে কুরআনের তাফসীর পড়ে আরো বিস্তারিতভাবে অনুধাবন করতে পারি। তখন থেকেই ইসলাম ধর্ম জানার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে গেল। তখন নামাজ শিক্ষা বই কিনে রাত ভর গোপনে গোপনে পড়তাম, এবং কুরআনের বাংলা তাফসীরও অধ্যয়ন করতে থাকি। এই সুবাদের কারণে আমি যাদের প্রাইভেট পড়াতাম, তারা অধিকাংশই মুসলমান ছিলো তাদেরকে ছোট ছোট সূরা যেমন, ফাতেহা ইখলাস ইত্যাদি পড়াতে আমাকে ব্যাক পেতে হয়নি। যখনই আমি তাদেরকে সূরা পড়াতাম তখনই আমি অন্য জগতে চলে যেতাম। ছাত্ররা আমার এই অবস্থা দেখে স্যার বলে ডাকতো, তখন বাস্তব জগতে ফিরে আসতাম। তখনই হৃদয়ে বদ্ধমূল ধারণা হলো আমি যা খুঁজছি, ইসলাম ধর্মেই তা নিহিত আছে এবং এই পথেই আমার চলা উচিত। একদিন রাতে স্বপ্নে দেখি যে, আমি হাটছি, হাটতে হাটতে গভীর গর্তে পড়ে যাওয়ার উপক্রম, হঠাৎ কে যেন আমার বাম হাত ধরে আমাকে উদ্ধার করলো। তারপর থেকে জীবনটা কেমন যেন হয়ে গেল। দুই মাস রাতে ঘুমাতে পারিনি। চোখ বুঝলেই দেখতাম লম্বা একজন লোক, মাথায় সাদা পাগড়ী, সাদা দাড়ি, সাদা দিশদাশা (জুব্বা) পরিহিত আমার সামনে আসছে। তাঁর স্পর্শটা সহ্য করতে পারতাম না। ঘুম ভেঙ্গে যেত, পরবর্তীতে লাইট জ্বালিয়ে শুইতাম, তখনও ঘুম আসতে চাইতো না। একবার স্বপ্নে দেখলাম, আমার এক বন্ধুর সাথে রাম ঠাকুর আশ্রমে যাচ্ছি, আশ্রমের দরজায় লাল কাপড় পরিহিত এক লোক আমার বন্ধুকে ভিতরে যেতে দিলো, আমাকে বাধা দিলো, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কেন ভিতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সে আমাকে বললো, ‘তুমি মুসলমান’। এভাবে আরো একদিন স্বপ্নে দেখি শাহরাস্তি মেহের কালীবাড়িতে হিন্দুদের বিরাট উৎসব হচ্ছে, আমি সেখানে গেলাম, রাত প্রায় ২/৩ টার দিকে বাড়িতে গিয়ে যখন ঘুমিয়ে পড়ি, কে যেন বলছে এখানে কেন এসেছ? তুমি তো মুসলমান! তারপর থেকে আমি আমার পরিবার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে লাগলাম। আর ভাবছি কি করে এটা সম্ভব! আমরা নয় ভাই, তিন বোন, আত্মীয়-স্বজন সামাজিকতা  এতসব ছিন্ন করে কি করে ইসলাম গ্রহণ করি? একবার ভাবছি আমার তো একটা জীবন, তার জন্য সবাইকে কি করে বিপদের মধ্যে ফেলে দেই! শেষে সিদ্ধান্ত নেই, আমার জীবন নষ্ট করে ফেলবো। তবুও সবাই সুখি হোক। 
  আমি বিভিন্ন নেশাতে আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়লাম। তার সাথে রাতের পর রাত জুয়া ও নেশায় নিজেকে ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আল্লাহ যাকে পছন্দ করেন, সে কি করে খারাপ হতে পারে, আমি যতই খারাপ হওয়ার চেষ্টা করেছি, আল্লাহ আমাকে ততই কাছে টেনে নিয়েছেন। আমি যখন ছাত্রদেরকে পড়াতাম তাদের (Home Work)  এর খাতা দেখে নম্বর দিয়ে সই করতাম অবচেতন ভাবেই সাইফুল ইসলাম  (মোঃ সাইফুল ইসলাম) লিখতে শুরু করলাম। একদিন এক ছাত্রের বাবা আমাকে বললো, অরুন তুমি এটা কি সই করেছ? আমি বললাম সাইফুল ইসলাম। তিনি তখন আমাকে বললেন, তুমি কি মুসলমান? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি তখন আমার মুখের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে দেখলেন।   আমার ছোট বেলা থেকেই অভ্যাস ছিলো অনেক রাতে বাসায় ফেরা। একদিন রাতে বাসায় ফিরছি, এমন সময় ফজরের আযান দিলো, আযানটি আমার হৃদয়ে এমনভাবে স্পর্শ করলো যে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। একবার প্রাইভেট পড়িয়ে বাসায় ফিরছি কুমিল্লা “দারোগাবাড়ি মাজার” নামে একটা মাজার ছিলো, সেখানে প্রতি বৃহস্পতি বার আছরের নামাযের পর যিকিরের আয়োজন হয়, ঠিক সেই সময় তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার কালে আল্লাহু আল্লাহু যিকিরের আওয়াজটা আমার কানে আসে। তখনই আমি সেখানে দাঁড়িয়ে গেলাম, সাধ্য নেই এক পা অগ্রসর হই। যিকির যখন শেষ হয় তখন আমি বাস্তবে ফিরে আসি। আমার জীবনটা ছিলো বেপরোয়া সিরিয়াসলি বলে কোন কাজ আমি করতাম না। আমার মা আমাকে প্রায়ই বলতো অরুন! তুমি সাবধানে চলাফের করবে! তুমি কিন্তু আর ৮/১০ জনের মতো নও। এখন বুঝতে পারছি মা কেন আমাকে এভাবে বললেন। যদি মায়ের কথা শুনতাম তাহলে আরও আল্লাহর কাছে প্রেমিক হতে পারতাম। এখনও আমার এই অভ্যাসটা আছে। চলছে ঘোড়া লাগামহীন। তাতে একটা লাভ এই যে, এই অভ্যাসের কারণে আল্লাহর দয়া পাচ্ছি বেশি করে। যেমন নামায, যিকির ইত্যাদি যখন কম হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তিনি তা আদায় করে নেন। যেমন ঘুম ভাঙ্গিয়ে নামায পড়ান, ইসলাম বিষয়ে নানা ধরণের জ্ঞান আমাকে শিখান। যা আমি কলমে লিখে বুঝাতে পারছি না।   যাক তখন থেকেই রাত জেগে ইসলামী বই-পুস্তক যেমন নামায শিক্ষা, কুরআনের তাফসীরসহ বিভিন্ন কিতাবাদি পড়তাম। এবং প্রায় রাতেই আমি নিজে নিজে গোপনে তাহাজ্জুদের নামায পড়তাম। আমার পরিবর্তন লক্ষ্য করে আমার পরিবার হয়ত বুঝতে পেরেছে, তাই আমাকে বিদেশে পাঠাতে চেষ্টা করতে লাগলো। আমিও মনে মনে ভাবলাম এটাই মোক্ষম সুযোগ। কারণ একবার যদি কোন মুসলিম কান্ট্রিতে চলে যেতে পারি, তবে নিজেকে মুসলমান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। তা ছাড়া আল্লাহর ঘর পবিত্র কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করতে পারবো। মদীনায় রাসূলের রাওজা মুবারক যিয়ারত করতে পারবো। আল্লাহ সুবহানাহুর নিকট অসংখ্য কৃতজ্ঞতা আদায় করছি, তিনি আমার মনের বাসনা পূরণ করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ শুকরান ইয়া রাব্ব!
পাসপোর্ট জমা দেই কিন্তু এক বৎসর পার হয়ে গেল ভিসা পাচ্ছি না। আমার যে কত অসুবিধা হচ্ছিল আল্লাহর হুকুম পালন করতে পারছি না বলে। ভিসা আসার ৩-৪ মাস আগে ইসলামকে ভালোভাবে জানার জন্য নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে ৪০ দিনের জন্য সিলেট থেকে তাবলীগ জামাতের শরীক হয়ে ঢাকায় আসি। সেখান থেকে ময়মনসিং যাই। এই ৪০ দিন আমি ইসলামকে কাছে থেকে দেখার ও বুঝার সুযোগ পাই। সেই ৪০ দিনের স্মৃতি আমাকে এখনও আপ্লুত করে রাখে।  চলবে…
মাসিক আল হুদা/ সেপ্টেম্বার ৬-২০১২

Monday, 22 October 2012

মাদ্রাসা নূরীয়ায় ৭ই রমজান

মুফতি সাহেবের বয়ানের একাংশ মাদ্রাসা নূরীয়ায় ৭ই রমজান



বয়ান টি ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন

Tuesday, 18 September 2012

সফর

শরীফ মুহাম্মদ

সতের বছর বয়স তখন। ফরিদাবাদ মাদরাসায় পড়ি। শরহে বেকায়া জামাতে। এ বছরেই এক সময় হঠাৎ বন্যার পদধ্বনি শোনা যেতে লাগলো। একেকদিন একেক জেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। খবর আসছে পত্র-পত্রিকায়। ঢাকার চারপাশে বন্যা। দেখতে দেখতে বুড়িগঙ্গাও যৌবন পেয়ে গেছে। ফুঁসে উঠে ড্রেন-নালা, খাল-ক্যানেল দিয়ে ঢাকা ঢুকে পড়ছে তার পানি।
একদিন ফজরের পর মাদরাসার ভেতরের ড্রেন দিয়ে দেখলাম একটু একটু পানি উঠছে মাঠে। উদ্বেগ ও আতঙ্কের চেয়ে উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য বোধ করলাম বেশি। কম বয়সের কারণে ও মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা হলে ছুটি প্রাপ্তির ঘোরে বন্যার ক্ষতিকর দিকটি মাথাতেই এলো না প্রথমে। ওই দিনই সকাল দশটার দিকে মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হলো। বলা হলো, যারা তাবলিগে যাবে, তারা যেন নাম লিখিয়ে দেয়। বুঝে না বুঝেই নাম দিয়ে দিলাম। এরপর দুপুরের আগে কাকরাইল ও বিকেলের মধ্যে আদমজী জুট মিলে।
তাবলিগ জামাতে সময় লাগানোর আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। তিনদিনের জামাত। কাকরাইল থেকে পাঁচ-ছয়জন যুক্ত হলেন। বাকিরা ছিলাম এক মাদরাসারই বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্র। এ ছিল অন্য রকম নিমগ্নতায় কৈশোরের শেষবেলা। আদমজী জুট মিলে থাকতে থাকতেই খবর পেলাম বন্যায় ডুবে যাচ্ছে সারাদেশ। উদ্বেগ চেপে বসলো। নিজেদের বিপন্নতার আশঙ্কার পাশাপাশি অন্যদের দুর্ভোগ ও অসহায়ত্ব নিয়েও মন খারাপ হতে লাগলো। তিনদিন শেষ হওয়ার পর যখন জামাতসহ বাসে ফিরছি তখন যাত্রাবাড়িতে এসে আমাদের মাদরাসার দলটি নেমে পড়লাম। নেমেই দেখলাম, চারদিকে পায়ে হাঁটা মানুষের স্রোত। ফরিদাবাদ পর্যন্ত যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। রাস্তাই নাকি নেই। চমকে উঠলাম। সেটি ছিল সেই আটাশির বন্যা।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই পোস্তগোলার দিকে গাট্টি-বোঁচকা মাথায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। জায়গায় জায়গায় দেখলাম, বালি ও সিমেন্টের বস্তা এনে সাধারণ মানুষ রাস্তার উপর ফেলছেন। উপরের অংশের পানি যেন এই নিম্নাঞ্চলে চলে না আসে সেজন্য রাস্তা এক পর্যায়ে আটকে দিয়ে হাজার হাজার মানুষ খাঁটাখাঁটুনি করছেন। পোস্তগোলায় যাওয়ার সময় রাস্তা থেকে বায়ে নেমে ম্যাচ ফ্যাক্টরির সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেলাম। দলবদ্ধ মানুষের স্রোতের সঙ্গে। এরপর পোস্তগোলা থেকে ফরিদাবাদে গেলাম কোমর সমান পানিতে ডুবে। একটি ভ্যানে সামানা তুলে তার চারপাশে ছিলাম আমরা। মাদরাসায় পৌঁছলাম সন্ধ্যার আগে। এরপর চারদিক ভুতুড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ফাঁকা মাদরাসায় সারারাত আমরা ক’জন ভয়ে ভয়ে কাটালাম। প্রাণভরে দুআ করলাম। নিজেদের বাড়িঘর ডুবে যাওয়া, বাসা বাড়িতে যেতে না পারার দুশ্চিন্তা নিয়ে অস্থির হয়ে আল্লাহর দরবারে কাঁদলাম।
পরদিন সকালে প্রথমে সদরঘাট ও পরে কমলাপুরে গিয়ে হাজির হলাম। একটা ট্রেন পেতে পেতে দুপুর ও ময়মনসিংহে গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা। ট্রেন থেকে নেমে বাসায় যাওয়ার পথে দেখলাম ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের প্রান্ত ছুঁয়ে আছে ব্রহ্মপুত্রের পানি। কোনো কোনো জায়গায় রাস্তা কিছুটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে আছে। রিক্সাচালককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, গত দু’দিন একটু একটু করে পানি চুয়ে চুয়ে শহরে ঢুকছিল। আজ বন্ধ। আজ থেকে বরং পানি একটু একটু কমছে। বাসায় গিয়ে পৌঁছার আগেই প্রশান্তি এসে ঠাঁই পেল মনে।
এরপর যখন বাসায় পৌঁছলাম তখন মনে হলো, বড় কোনো বিপর্যয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর আবার যেন পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে। আল্লাহ তাআলার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় হৃদয়-মন আপ্লুত হয়ে গেল। জীবনে প্রথম তাবলিগের সফরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল গভীর উৎকণ্ঠার ঘটনা। আবার সফর শেষের সঙ্গে ছিল প্রশান্তির অভূতপূর্ব অনুভূতি। এ উদ্বেগ ও প্রশান্তির কলকাঠি আমার হাতে ছিল না। ছিলাম কেবল ফলভোগী। আল্লাহ তাআলার কাছে আত্মসমর্পণ ও সাহায্য চাওয়ার সবক শেখায় তার দীনের মেহনত। এই মেহনতে নিমগ্নতার একটি প্রধান উপায় তাবলিগ জামাত। এ জামাতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আল্লাহ তাআলা সবাইকে দান করুন।

তাবলিগ, বিশ্বব্যাপী কার্যকর এক ইসলামি আন্দোলন



লিখেছেন হাবিবুল্লাহ ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১১



আখেরি নবী মুহাম্মদ সঃ এর পরে দীনের দাওয়াতের গুরু দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়ে উম্মতের উপর। দাওয়াতের কাজ করার কারণেই আল্লাহ তালা এই উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে ঘোষণা করেন।
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّـهِ তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। সুরা আলে ইমরান = ১১০
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّـهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎ কর্ম করে এবং বলে আমি একজন আজ্ঞাবহ তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার? সুরা ফুসসিলাত = ৩৩
যুগে যুগে মুসলমানদের মধ্যে দীনদার পরহেজগার ওলামা মাশায়েক, আলিয়ায়ে কেরাম তাবলীগের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯১০ সালে ভারতের রাজস্থানের মেওয়াট নামক স্থান থেকে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুসলিহে মিল্লাত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ.) তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজেই এ কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায়ই এ মহত কার্যক্রম ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াছের (রহ.) মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) তাবলীগ জামাতের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভীও এ কার্যক্রমের প্রাণপুরুষ ছিলেন। মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) পরবর্তী সময়ে তাবলীগ জামাতের অন্যতম আমির বা নেতা ছিলেন। বাংলাদেশে তাবলীগ জমাতের আজীবন আমির ছিলেন মাওলানা আব্দুল আজিজ (রহ.)। তিন-চার দশকের মধ্যেই তাবলীগের কার্যক্রম সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তার লাভ করে এবং ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

৬ টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর বিশেষ তাগিদ সহকারে আমল করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হলেও জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ দীনের উপর আমল করার করার প্রতি উৎসাহিত করা হয় । জোর নয়, নরম স্বভাব, উন্নত চরিত্র, মার্জিত আচরণ এর মাধ্যমে হেকমতের সহিত মানুষকে দীনের প্রতি ডাকা , সর্বোপরি সুন্নাতের উপর আমল করার মাধ্যমে আল্লাহ তালার সন্তুষ্টি অর্জন করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে। সুরা নাহাল = ১২৫

তাবলীগ জামাতের বিশেষ একটি গুণ হচ্ছে তারা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে দীনের দাওয়াতের কাজ করে। কারো কাছ থেকে টাকা পয়সা নেয় না। ছওয়াল করেন, এবং ছওয়ালের ভানও করে না। কোরানের এই আয়াতের সাথে হুবহু মিলে যায় তাদের এই গুনটি। আল্লাহ তালা বলেন اتَّبِعُوا مَن لَّا يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُم مُّهْتَدُونَ অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় কামনা করে না, অথচ তারা সুপথ প্রাপ্ত। সুরা ইয়াছীন =২১

পরিবেশ অনুকূল হোক আর প্রতিকুল হোক বিশ্বের প্রায় সব কটি দেশেই তাবলীগের দাওয়াতি কাজ চলছে আলহামদুলিল্লাহ। এটা নিশ্চয় তাদের এখলাছের কারণে আল্লাহর বিশেষ রহমতে সম্ভব হচ্ছে। এবং তাবলীগের দাওয়াতি কাজের ফলে অমুসলিম মুসলমান হচ্ছে আর মুসলমানগণ দীনের প্রতি আরোবেশি আগ্রহী হচ্ছে। সুন্নাত মতে আমল করা শিখছে।
দাওয়াতের কাজ করা বর্তমানে কতটা জরুরী তা দেখে নিতে পারেন এই খানে
তারা বলে থাকেন ৬ টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব সহকারে আমল করতে পারলে দীনের অন্য সব বিষয়ে আমল করা সহজ হয়ে যায়।
যে বিষয় গুলির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় তা হল
১/ কালেমা ২/ নামাজ ৩/ এলম ও জিকির ৪/ ইকরামুল মুসলিমীন ৫/ তাসহীহে নিয়ত ৬/ তাবলীগ।

এই বিষয় গুলির প্রত্যেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১/ কালেমা। لا اله الا الله محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم
অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনও ইলাহ নাই, মুহাম্মদ [সঃ] আল্লাহর রসুল।
কালেমা থেকে পরিপূর্ণ ঈমান বুঝানো হয়ে থাকে। তাবলীগ ওয়ালারা এর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাতে শিরক থেকে বাছার জন্য এবং প্রকৃত ইমানের পরিচয় তুলে ধরার জন্য বলে থাকেন , আল্লাহ তালা ছাড়া অন্য যা কিছু আমরা দেখি বা না দেখি সব জিনিসই মাখলুখ। মাখলুখ কিছুই করতে পারে না আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া । আর আল্লাহ তালা সব কিছুই করতে পারেন মাখলুখের সাহায্য ছাড়া।

ঈমানে মুফাসসালের ঘোষণা অনুযায়ী ৭টি জিনিসের প্রতি ঈমান আনতে হয়। (১) আল্লাহ, (২) ফেরেশতাগণ (আ.), (৩) কিতাবসমূহ, (৪) রসূলগণ, (৫) আখেরাত, (৬) ভাগ্যে ভালমন্দ যা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে অর্থাৎ তাকদির ও (৭) মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান। ঈমান অর্থ শুধু বিশ্বাস নয়, বরং অন্তরে বিশ্বাস, মুখে ঘোষণা এবং বাস্তবে কাজে পরিণত করার নামই হচ্ছে ঈমান।

ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে , কারো কথাকে তার বিশ্বস্ততার নিরিখে মনে - প্রাণে মেনে নেয়া । অপর দিকে রসূল ( সা: ) - এর কোন সংবাদ কেবলমাত্র রসূলের উপর বিশ্বাসবশতঃ মেনে নেয়াকে শরিয়তের পরিভাষায় ঈমান বলে । যুহাইর ইবনে হরব ( রঃ ) আবু হোরায়রা থেকে রেওয়ায়ত করেছেন , রসূলে পাক ( সা: ) এরশাদ করেছেন , ঈমানের শাখা সত্তরটির ও বেশি অথবা ষাটটির কিছু বেশি । এর সর্বোচ্চ শাখা হল লা ইলাহা ইল্লাললাহ ( অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত মাবুদ নাই ) এই কথা স্বীকার করা আর সর্বনিম্ন শাখা হল পথের উপর থেকে ক্লেশ দায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা । আর লজ্জা হল ঈমানের বিশেষ শাখা সমূহের অন্যতম । ( মুসলিম )

ঈমানের শাখা সমূহের বর্ণনা: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা , আল্লাহ পাক ব্যতিরেকে বাকী সব আল্লাহর সৃষ্ট ( মখলুক ) ও ধ্বংসশীল এ বিশ্বাস করা , সমস্ত পয়গম্বরদের প্রতি ঈমান আনয়ন , ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনয়ন , আল্লাহর নাযিল কৃত সমস্ত কিতাবের প্রতি ঈমান আনয়ন , কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন , তাকদিরের প্রতি ঈমান আনয়ন , মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়ার উপর বিশ্বাস , জান্নাতকে বিশ্বাস করা , জাহান্নামকে বিশ্বাস করা , আল্লাহর সহিত ভালবাসা রাখা , আল্লাহর সন্তুষ্টি কল্পে কাউকে ভালবাসা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি কল্পে কারো উপর অসন্তুষ্টি হওয়া , রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের সহিত ভালবাসা রাখা , একনিষ্ঠ ভাবে আল্লাহর ইবাদত করা , আল্লাহর কাছে তওবা করা , আল্লাহর উপর আশা রাখা , লজ্জাশীলতা , আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা , অঙ্গীকার পূরণ করা , ধৈর্যধারণ করা , বিনয়ী হওয়া , আল্লাহর সৃষ্ট সকল মখলুকের উপর স্নেহ ও দয়া , আল্লাহর ফয়সালার উপর রাজী হওয়া , আল্লাহর উপর ভরসা করা , স্বৈরচারিতা বর্জন করা , গোস্বা পরিহার করা , কুঅভ্যাস পরিহার করা , দুনিয়ার মহব্বত পরিহার করা । কালিমা তাওহীদ পাঠ করা , কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করা , ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা , ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয়া , দুয়া করা , যিকির করা , বেহুদা ও নিষিদ্ব কথাবার্তা হতে বেঁচে থাকা , পবিত্রতা অর্জন করা , নামাজ কায়েম করা , সদকা আদায় করা , নিজের দ্বীন রক্ষার্থে কোথা ও পালিয়ে যওয়া , ইতিকাফ করা , হজ্জ করা , মান্নত পূরন করা , কসমের প্রতি খেয়াল রাখা , কাফফারা আদায় করা , সতর ঢেকে রাখা , কুরবানী করা , ঋণ পরিশোধ করা , লেনদেনে ন্যায় - নীতি বজায় রাখা , শরীয়ত বিরোধী কাজ হতে বেচে থাকা , সত্য সাক্ষ্য দেওয়া , কাপন - দাপনের ব্যবস্হা করা , বিবাহ করে সতীত্ব অর্জন করা , পরিবার পরিজনের হক আদায় করা , মাতা - পিতার খিদমত করা ও তাদের কষ্ট না দেয়া , মনিবের অনুগত হওয়া , বিচারে ন্যায় নীতি অবলম্বন করা , মুসলিম জামাতের অনুসরণ করা , শাসকের অনুসরণ করা , মানুষের মাঝে সংশোধন করে দেওয়া , ভাল কাজে সাহায্য করা ও মন্দ কাজে সাহায্য না করা , সত্য কথা বলা , মন্দ কথা হতে নিষেধ করা , দণ্ড বিধি প্রতিষ্ঠা করা , আমানত আদায় করা , অভাবী বা বিপদের সম্মুখীনকে ধার দেওয়া , সন্তোষজনক মুআমিলা করা , প্রতিবেশীর সহিত সুন্দর ব্যবহার করা , মাল যথা স্থানে খরচ করা , সালামের জবাব দেয়া , হাঁচি দাতার জবাবে ইয়ার হামু কাল্লাহ বলা , বেহুদা খেল তামাসা হতে বেঁচে থাকা , মানুষের ক্ষতি না করা , কষ্টদায়ক জিনিস রাস্তা হতে অপসারণ করা ।
বাকি বিষয় গুলি পরে আলোচনা করার আশা রাখি ইনশা আল্লাহ।